গাজীপুর সদর সংবাদদাতা :
“মামা একটি কলম নিলাম, ৫ টাকা রেখে গেলাম”। একটি খাতা নিলাম, ২০ টাকা দিলাম। প্রতিদিন বিদ্যালয় চলাকালীন সময়ে নিয়মিত এই চিত্র দেখা যায় গাজীপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠ সংলগ্ন ছোট একটি দোকানে। যেখানে ক্রেতা এই বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আর বিক্রেতা দৃষ্টি শক্তিহীন খাইরুল ইসলাম। শিক্ষার্থীদের সততা ও ভালবাসার উপর ভর করে এভাবেই চলছে খাইরুলের দিনকাল। ছোট এই দোকান থেকে যে আয় হয় তা দিয়েই কোনমতে টেনেটুনে চলছে তার সংসার।
গাজীপুর গ্রামের তাইজুল ইসলামের সন্তান খাইরুল ইসলাম। খায়রুলের বয়স চল্লিশের কোটা ছুঁয়েছে। স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে সংসার তার। দোকান ছাড়া সহায় সম্বল বলতে শুধু রয়েছে ভিটেমাটি। ছোটকালে তার পরিবার অভাব ও দারিদ্রের কষাঘাতে পিষ্ট হওয়ায় ইচ্ছা থাকা সত্বেও লেখাপড়ায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গন্ডিতে সীমাবদ্ধ। এর পর মূলত শ্রম বিক্রি করেই চলত তার দিনকাল।
খায়রুল জন্মান্ধ নয়। দারিদ্রতাই কেড়ে নিয়েছে তার চোখের আলো। ২০১১ সালের দিকে তার মাথা ব্যাথা শুরু হয়। পরে দেখা দেয় চোখের সমস্যা। চিকিৎসকরা জানান গ্লোকমায় আক্রান্ত হয়েছে তার দু”চোখ, নির্দেশনা দেন উন্নত চিকিৎসার। কিন্তু তার সে সুযোগ আর হয়ে উঠেনি। ধীরে ধীরে কমতে থাকে চোখের আলো। ২০১২ সালের দিকে পুরোপুরি দৃষ্টিহীন হয়ে পড়েন তিনি। তার চোখের আলো নিভে যাবার সাথে সাথে তার পুরো পরিবারে নেমে আসে অন্ধকার। থমকে দাড়ায় দিন আনা দিন খাওয়া একটি সংসার।
এরপর অনেকেই ভিক্ষাবৃত্তিতে নামার পরামর্শ দেন তাকে, কিন্তু আত্ম সচেতন খায়রুল সাথে সাথে নাকচ করে দেন প্রস্তাব। তবে জীবন সংসারের লড়াইয়ে দমে যাননি খাইরুল। তিনি তার পরিবারের কাছে ব্যবসা করবেন বলে নিজের সিদ্ধান্তের কথা জানান, তবে বাধ সাধেন সবাই। সবারই এক কথা তার দৃষ্টিহীনতার সুযোগে চুরি হয়ে যাবে সবকিছু, সে হারাবে সর্বস্ব। কিন্তু খায়রুলের মাথায় আসে ভিন্ন ধর্মী চিন্তা।
চোখের আলোহীন খায়রুলের জীবনে ছোট শিশুদের সততার আলোর জোগায় আশা। শিশু শিক্ষার্থীদের সততা ও ভালবাসায় তিনি বাড়ীর কাছের প্রাথমিক বিদ্যালয় এলাকায় ছোট দোকান খুলে বসেন। যেখানে তার ক্রেতা বিদ্যালয়ের কোমলমতি শিশু শিক্ষার্থীরা। প্রতিদিন বিদ্যালয়ের সময় হলে বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই তাকে বাড়ী থেকে বিদ্যালয়ের পাশের দোকানে আসা যাওয়া করতে সহায়তা করেন। কারো কিছু প্রয়োজন হলে নিজেরা ইচ্ছেমত খাইরুলের দোকান থেকে পন্য নিয়ে যান, দাম তুলে দেন তার হাতে। বিকেলে সারাদিনের বিক্রির টাকাও শিক্ষার্থীরা গুনে তার হাতে তুলে দেয়। এভাবেই দীর্ঘ সাত বছর ধরে দোকান পরিচালনা করে আসছে দৃষ্টিহীন খাইরুল। নম্র ভদ্র ও বিনয়ী খায়রুল শিক্ষার্থীদের অতি আপনজন হয়ে উঠেছেন। শিক্ষার্থীরাও তার প্রতি সদয়। খায়রুল এখন সবার খাইরুল মামা।
খাইরুল বলেন, তার এই ছোট দোকানে বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের চাহিদা মেটে না। তবু সামর্থ অনুযায়ী বিভিন্ন শিক্ষা উপকরণ ও টিফিনের খাবার বিক্রি করে থাকেন। শিক্ষার্থীদের সততার উপর ভরসা করেই তার এই দোকান চলছে। বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পণ্য নিয়ে টাকা না দেয়ার মানসিকতা নেই। এজন্যই তিনি দোকান পরিচালনা করতে পারেন। প্রতিদিন তার বিক্রি হয় ৬ থেকে ৭ শত টাকা। আয় দাড়ায় গড়ে ১শ টাকা। এ দিয়েই তার চার সদস্যের পরিবারের ব্যয় নির্বাহ চলছে। দুই সন্তানের মধ্যে খাইরুলের এক মেয়ে এবার এই বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা দিয়েছে। ছেলে প্রথম শ্রেণীর শিক্ষার্থী। জীবন মান নিয়ে খাইরুলের কোন আক্ষেপ নেই, তবে নিজে চোখের চিকিৎসা করাতে না পারায় তার খেদ রয়ে গেছে। এখনও স্বপ্ন রয়েছে কারো সহায়তা পেলে ফের চোখের চিকিৎসা শুরু করবেন। যদি ফিরে আসে দৃষ্টি।
গাজীপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মাহিনুর রহমান জানান, খাইরুলের অসহায়ত্ব ও মানবিকতার কথা বিবেচনা করে আমরা বিদ্যালয় এলাকায় তাকে ছোট দোকান পরিচালনার অনুমতি দিয়েছি। বিদ্যালয়ে আমরা শিশুদের স্বাভাবিক পাঠদানের পাশাপাশি নীতি, নৈতিকতা, সততা ও আদর্শের শিক্ষা দিয়ে থাকি। এই শিক্ষায় আলোকিত হয়ে বিদ্যালয়ের কোমলমতি শিক্ষার্থীরা দৃষ্টিহীন খাইরুলের দোকান চালাতে প্রতিনিয়ত সহযোগিতা করে যাচ্ছেন। এটি সত্যিই অনুকরনীয়।