গণবাণী ডট কম:
পৃথিবীর স্বর্গ কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা সংক্রান্ত ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ বিলোপ করার ঘোষণা দিয়েছে দেশটিতে ক্ষমতাসীন মোদী সরকার। এ অনুচ্ছেদের কারণে জম্মু ও কাশ্মীর অন্য যেকোন ভারতীয় রাজ্যের চেয়ে বেশি স্বায়ত্বশাসন ভোগ করতো। এই ধারাটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ, কারণ এর ভিত্তিতেই কাশ্মীর রাজ্য ভারতের অন্তর্ভূক্ত হয়েছে। এ অনুচ্ছেদ জম্মু ও কাশ্মীরকে নিজেদের সংবিধান ও একটি আলাদা পতাকার স্বাধীনতা দেয়। এছাড়া পররাষ্ট্র সম্পর্কিত বিষয়াদি, প্রতিরক্ষা এবং যোগাযোগ বাদে অন্যান্য সকল ক্ষেত্রে স্বাধীনতার নিশ্চয়তাও দেয়। খবর : বিবিসি ও অন্যান্য সূত্র।
সোমবার সংসদে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বিরোধীদের তুমুল বাধা ও বাগ-বিতণ্ডার মধ্যে এই সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। এই মর্মে সরকারের পক্ষ থেকে একটি বিজ্ঞপ্তিও জারি করা হয়েছে, যাতে রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোভিন্দ স্বাক্ষরও করেছেন।
এই সিদ্ধান্ত ঘোষণার আগে সকালে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভার এক বৈঠকে বিস্তারিত আলোচনা হয়। মন্ত্রীসভার ঐ বৈঠক শুরু হওয়ার আগে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সাথে একান্ত বৈঠক করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ।
এই ৩৭০ অনুচ্ছেদের সুবাদে কাশ্মীরের স্থায়ী বাসিন্দারাই শুধুমাত্র সেখানে বৈধভাবে জমি কিনতে পারতেন, সরকারি চাকরি করার সুযোগ পেতেন এবং সেখানে ব্যবসা পরিচালনা করতে পারেন।
ঐ অনুচ্ছেদ বিলোপ করার বিষয়টি বিজেপি’র পুরনো রাজনৈতিক এজেন্ডাগুলোর একটি। এই সিদ্ধান্তের ফলে সেখানে তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ অনুচ্ছেদ বাতিলের কারণে এখন জম্মু এবং কাশ্মীর ‘ইউনিয়ন টেরিটরি’ বা কেন্দ্রীয়ভাবে শাসিত রাজ্য হিসেবে পরিচালিত হবে।
লাদাখ কেন্দ্রশাসিত তৃতীয় একটি এলাকা হিসেবে বিবেচিত হবে।
কাশ্মীরের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতি টুইট করেছেন যে, এই সিদ্ধান্ত কার্যকরভাবে ভারতকে ঐ রাজ্যের দখলদার বাহিনী হিসেবে প্রমাণ করেছে।
ভারত এবং পাকিস্তান দুই দেশই মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ কাশ্মীর রাজ্যের পুরো অংশের নিয়ন্ত্রণ দাবি করে, তবে উভয় দেশই সেখানকার অংশবিশেষ নিয়ন্ত্রণ করে। গত তিন দশক ধরে ভারত শাসিত কাশ্মীরের কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ হচ্ছে।
মুসলিম-গরিষ্ঠ কাশ্মীরের ‘ডেমোগ্রাফি’ বা জনসংখ্যাগত চরিত্র বদলে দেওয়াই সংবিধানের ৩৭০ ধারা বিলোপের পেছনে আসল উদ্দেশ্য কি না, তা নিয়ে এখন তীব্র বিতর্ক দানা বাঁধছে।
পার্লামেন্টে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের নাটকীয় ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল ঘোষণার কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস বুঝিয়ে দেয়, তারা এই পদক্ষেপের মধ্যে অন্য অভিসন্ধি দেখছে।
রাজ্যসভায় কংগ্রেসের বিরোধী দলনেতা গুলাম নবি আজাদ তৃণমূল-সহ অন্য কিছু বিরোধী দলকে পাশে নিয়ে নিয়ে ঘোষণা করেন, “ধর্মীয় বা সাংস্কৃতিকভাবে কাশ্মীরের যে অনন্য চরিত্র, কলমের এক খোঁচায় বিজেপি সেটাই বরবাদ করে দিতে চাইছে।”
তিনি বলেন, “মনে রাখতে হবে সীমান্তবর্তী রাজ্য জম্মু ও কাশ্মীর এমন একটি প্রদেশ, যার সংস্কৃতি, ইতিহাস, ভূগোল, রাজনীতি সবই বাকি দেশের চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা।”
“এই রাজ্যের লাদাখে বৌদ্ধ ও মুসলিমরা থাকেন, কাশ্মীরে থাকেন মুসলিম, পন্ডিত ও শিখরা। আর জম্মুতে জনসংখ্যার ষাট শতাংশ হিন্দু, আর বাকি চল্লিশ শতাংশ মুসলিম।”
“এমন একটি রাজ্যকে যদি কেউ এক সূত্রে বেঁধে রাখতে পারে, সেটা ছিল সংবিধানের ৩৭০ ধারা। এই ধারায় রাজ্যের সব ভাষা-ধর্ম-সংস্কৃতির মানুষের জন্যই বিশেষ ব্যবস্থা ছিল - যা আজ বিজেপি শেষ করে দিল।”
ভারত-শাসিত কাশ্মীরের সাবেক এই মুখ্যমন্ত্রী যে কথাটা কিছুটা রাখঢাক করে বলছেন, কাশ্মীরি অ্যাক্টিভিস্টরা সেটাই বলছেন আরও খোলাখুলি - যে এর মাধ্যমে কাশ্মীর উপত্যকা বা ভ্যালির ডেমোগ্রাফি বদলে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে।
কাশ্মীরের বারামুলা কলেজে একসময় অধ্যাপনা করেছেন নাজির আহমেদ শল, কাশ্মীরিদের ‘সেলফ ডিটারমিনেশন’ বা আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবিতে তিনি গত বহু বছর ধরে লন্ডনে আন্দোলন চালাচ্ছেন।
লন্ডন-ভিত্তিক জাস্টিস ফাউন্ডেশনের কর্ণধার অধ্যাপক শল বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, “৩৭০ ধারা বিলোপের আগেই অন্তত দুটি পদক্ষেপ থেকেই পরিষ্কার আঁচ করা যাচ্ছিল বিজেপি সরকার কাশ্মীরের আবহমান কালের চরিত্রটা পাল্টে দিতে চাইছে।”
ভারতে ক্ষমতাসীন দল বিজেপি বা তাদের পুরনো অবতার জনসঙ্ঘ অবশ্য বহু বছর ধরেই ভারতীয় সংবিধানের এই বিতর্কিত ধারাটি বিলোপ করার দাবি জানিয়ে আসছিল।
বিজেপির বক্তব্য ছিল, কাশ্মীর যাতে সম্পূর্ণভাবে ভারতের সাথে সংযুক্ত বা ‘আত্মীকৃত’ হতে পারে সে জন্যই এই ধারাটি বিলোপ করা দরকার।
স্বাধীনতার সাত দশক পর ভারতে একটি বিজেপি সরকার অবশেষে তাদের এই বহু পুরনো রাজনৈতিক এজেন্ডাটি বাস্তবায়ন করল।
“প্রথমত ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল কাশ্মীরের জন্য যে ‘ডোভাল ডকট্রিন’ ফর্মুলেট করেছিলেন তার একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবনাই ছিল ভারতের অন্যান্য অংশ থেকে লোকজনকে কাশ্মীরে এনে বসত করানো।”
“যেমন ওই ডকট্রিনে কাশ্মীরে হিন্দু পন্ডিতদের জন্য আলাদা কলোনি স্থাপন, কাশ্মীরে শিল্পাঞ্চলের জন্য বাকি ভারত থেকে শিল্পশ্রমিকদের এনে বসতি গড়া কিংবা ভারতীয় সেনার সাবেক সদস্যদের এনে কাশ্মীরে জমি দেওয়ার কথাও বলা হয়েছিল।”
“দ্বিতীয়ত, বিগত সাধারণ নির্বাচনের আগে বিজেপি তাদের নির্বাচনী ইশতেহারেও সংবিধানের ৩৭০ ধারা ও আর্টিকল ৩৫এ বাতিল করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল।”
“এমন কী তারা সরাসরি ঘোষণা করেছিল বিজেপিকে ভোট দিয়ে জেতালে কাশ্মীরে জমিজিরেত কিনতে পারবেন আনায়াসেই।”
ফলে অধ্যাপক শলের বলতে কোনও দ্বিধা নেই, “এদিনের পদক্ষেপ আসলে একটি সাংবিধানিক সন্ত্রাসবাদ-যার মাধ্যমে কাশ্মীরের স্বকীয় পরিচিতি বা আইডেন্টিটি ধ্বংস করে ডেমোগ্রাফিক রিইঞ্জিনিয়ারিং-য়ের চেষ্টা চালানো হচ্ছে।”
এটা ঠিকই যে বিজেপি গত নির্বাচনের আগে পোস্টার দিয়েছিল, “ঠিকঠাক ভোট দিলে আপনার ভোট কিন্তু আপনাকে কাশ্মীরে জমির প্লটও এনে দিতে পারে।”
বস্তুত ৩৭০ ধারা বিলোপের সমর্থনে বিজেপি ঠিক এই যুক্তিটাই দিচ্ছে যে এতদিনে কাশ্মীর ভারতের আর পাঁচটা রাজ্যের সঙ্গে সমান কাতারে এল, কাশ্মীরের ভারতভুক্তি সম্পূর্ণ হল।
বিজেপির তাত্ত্বিক নেতা ও পলিসি রিসার্চ সেলের সদস্য অনির্বাণ গাঙ্গুলির কথায়, “জনসঙ্ঘের প্রতিষ্ঠাতা শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি আজ থেকে ছেষট্টি বছর আগে কাশ্মীরের সর্বাত্মক ভারতভুক্তির জন্য যে ৩৭০ ধারা বিলোপের দাবি জানিয়েছিলেন, আজ তাঁর রাজনৈতিক উত্তরসূরীরাই সেই স্বপ্নকে পূরণ করলেন।
“আর ডেমোগ্রাফি পরিবর্তনের কথা যারা বলছেন, সেটা এই পটভূমিতে সম্পূর্ণ অবান্তর।”
“কারণ ৩৭০ ধারা এতদিন ছিল বলেই কাশ্মীরে যারা তফসিলি জাতি বা উপজাতিভুক্ত, কিংবা অন্যান্য পশ্চাৎপদ শ্রেণীর - তারা বিভিন্ন সরকারি সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছিলেন।” “কেন শুধু কাশ্মীরে বসবাস করার জন্য এই মানুষগুলো দিনের পর দিন ভারতে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হয়ে থাকবেন? আর এটা তো ভারতীয় সংবিধানেরও পরিপন্থী-কাজেই এটা অ্যাড্রেস করতেই হত”, বলছেন তিনি।
অতএব কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বিলুপ্তির মধ্যে দিয়ে ভারত-শাসিত ওই প্রদেশের সোয়া কোটিরও বেশি মানুষ অবশেষে বাকি দেশের সঙ্গে সমানাধিকার পেল এবং একই মূল ধারায় মিশতে পারল বলে বিজেপি দাবি করছে।
কিন্তু এই পদক্ষেপের বিরোধীরা মনে করছেন, এর মধ্যে দিয়ে আসলে কাশ্মীরের বিশেষ স্বীকৃতি তুলে নিয়ে উপত্যকার দরজা খুব সচেতনভাবে খুলে দেওয়া হল ভারতের সব বর্ণ-ধর্ম-ভাষার মানুষের জন্য।
ইসরায়েল একদিন যা ফিলিস্তিনি-অধ্যুষিত অঞ্চলে করেছে অথবা চীনও করেছে তিব্বতে-সুন্নি মুসলিম-গরিষ্ঠ কাশ্মীরে ভারতও ঠিক সেই একই ধরনের পদক্ষেপ নিল বলে তারা মনে করছেন।