গণবাণী ডট কম:
ওরা আমার কলিজার টুকরার হাত গরম পানিতে পুড়াইয়া দিছে। আমার সোনার চাদটারে না খাওয়াইয়া কঙ্কাল বানাইয়া দিছে। অপরহণের ২৮ দিন পর উদ্ধার হওয়া ৮ মাসের শিশু সন্তানকে নিজের বুকে ফিরে পেয়ে কথা গুলো বলছিলেন সন্তানের শোকে পাগল প্রায় এক মা। এসময় তিনি বারবার নাড়ী ছেড়া শিশু সন্তানকে শক্ত করে বুকে জড়িয়ে ধরছিলেন আর কাঁদছিলেন।
মাতৃস্নেহের এমনি অভূতপূর্ব দৃশ্য দেখা গেল বৃহস্পতিবার ২৮ দিন নিজের শিশু সন্তানতে ফিরে পাওয়ার পর।
গাজীপুর মহানগরীর বাসন থানাধীন নাওজোড় এলাকার নিজ ভাড়া বাসা থেকে পাশের ঘরের ভাড়াটিয়া এক নারী ভিক্ষাবৃত্তিতে ব্যবহার করার উদ্দেশ্যে ৮ মাস বয়সী শিশু আব্দুল্লাহ আল নোমানকে চুরি করে পালিয়ে যায়। পরে মহানগর পুলিশ গোয়েন্দা তথ্য ও তথ্য প্রযুক্তির সহায়তায় ছদ্মবেশে অভিযান চালিয়ে ময়মনসিংহ শহরের ফুটপাথ থেকে শিশুটিকে উদ্ধার ও জড়িতদের গ্রেফতার করে।
গ্রেফতার আসামারী হলো, বগুড়া জেলার সারিয়াকান্দি থানারা পাইকরতলী এলাকার মৃত লুৎফর রহমানের ছেলে মোঃ আবু সাঈদ ওরফে সুমন (৪০) এবং তার স্ত্রী কুড়িগ্রাম জেলার উলিপুর থানার অনন্তপুরের আফজাল হোসেন ওরফে খয়বর আলীর মেয়ে মোসাঃ আইরিন (৩৪)। তারা একই এলাকায় পাশের ভাড়া বাসায় থাকতো।
এ উপলক্ষে বৃহস্পতিবার সকালে গাজীপুর মহানগর পুলিশ কমিশনার কার্যালয়ে এক সাংবাদিক সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।
গাজীপুর মহানগর পুলিশের উপ পুলিশ কমিশনার (অপরাধ-উত্তর) আবু তোরাব মো: সামসুর রহমান জানান, উদ্ধার হওয়া শিশুটি গাজীপুর মহানগরীর বাসন থানাধীন নাওজোড় এলাকার বাসিন্দা মোক্তার হোসেন (৪৪) ও মা মনিরা আক্তার রুমার (৩০) তৃতীয় সন্তান। গত এপ্রিল মাসের ৩ তারিখ দুপুরে শিশুটির পিতা কাজে প্রয়োজনে বাইরে ছিলেন। শিশুটির মা শিশুটিকে গোসল করিয়ে ঘরের বিছানায় শুইয়ে রেখে পুনরায় কাপড় ধৌত করা জন্য গোসলখানায় যান। এসময় প্রতিবেশী ভাড়াটিয়া ও গ্রেফতার আসামী মোসাঃ আইরিন (৩৪) সেই ঘরের উপস্থিত ছিল। কিছুক্ষণ পরে কাপড় ধোয়া শেষে শিশুটির মা ঘরে ফিরে দেখেন তার শিশুপুত্রটি বিছানায় নেই, সাথে সেই মহিলাও নেই। পরে শিশুটির মা আশেপাশের ভাড়াটিয়াসহ বিভিন্ন স্থানে তার শিশু সন্তানকে খোঁজাখুঁজি করেও কোন সন্ধান পাননি। খোঁজাখুঁজির একপর্যায়ে দেখতে পান যে, পাশের রুমের ভাড়াটিয়া গ্রেফতার আসামী মোসাঃ আইরিনও তার ঘরে নেই। তখন তার ব্যবহৃত মোবাইলে ফোন করলে মোবাইল ফোনটিও বন্ধ পাওয়া যায়। তখন সন্দেহ হলে বিষয়টি বাসন থানা পুলিশসে জানানো হলে পুলিশ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে। তারা বুঝতে পারে আসামী সুমন ও তার স্ত্রী আইরিন পরিকল্পিতভাবে শিশুটিকে চুরি করে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে গেছে। পুলিশ তথ্য প্রযুক্তির মাধ্যমে আসামীদের নাম পরিচয় শনাক্ত করে। পরে এ ঘটনায় শিশুটির পিতা বাদী হয়ে গ্রেফতার আসামীদের বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে মামলা দায়ের করেন।
মামলা দায়েরে পর পুলিশ কুড়িগ্রাম জেলায় অভিযান পরিচালনা করে এবং তথ্য প্রযুক্তির মাধ্যমে আইরিনের স্বামী মোঃ আবু সাঈদ ওরফে সুমনকে গ্রেফতার করে আদালতে সোর্পদ করে। কিন্তু শিশুটি উদ্ধার না হওয়ায় বিভিন্ন জেলায় আরো অভিযান পরিচালনা করে।
পুলিশের ঐ কর্মকর্তা আরো জানান, অভিযান পরিচালনা করাকালে গোপন সূত্রে জানা যায় যে, আসামী মোসাঃ আইরিন শিশুটিকে নিয়ে ঢাকায় বিমানবন্দর রেলস্টেশন,কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনসহ ব্যস্ততম এলাকায় ভিক্ষাবৃত্তি করে। সেখানেও অভিযান চালিয়ে পাওয়া যায়নি। এক পর্যায়ে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে জানা যায়, আসামী মোসাঃ আইরিন শিশুটিকে নিয়ে ময়মনসিংহ কোতয়ালী থানাধীন বিভিন্ন এলাকায় ভিক্ষাবৃত্তির কাজ করছে। এমন সংবাদের ভিত্তিতে গত ১লা মে জিএমপির একটি দল ময়মনসিংহ জেলার কোতয়ালী থানার বিভিন্ন এলাকায় ছদ্মবেশে অভিযান পরিচালনা করে। সর্বশেষ বৃহস্পতিবার ভোর সোয়া ৬টার দিকে ময়মনসিংহ জেলার কোতয়ালী মডেল থানাধীন চায়না মোড় এলাকা হতে আসামী মোসাঃ আইরিনকে গ্রেফতার করা হয়। এ সময় তার হেফাজত থেকে শিশুটি উদ্ধার করা হয়।
গ্রেফতারের পর জিগ্যাসাবাদে আইরিন জানায়, সে ভিক্ষাবৃত্তিতে ব্যবহার করার জন্য শিশুটিকে চুরি করেছিল। তার স্বামী মারা গেছে, শিশুপুত্র নিয়ে তার থাকার কোন জায়গা নেই এমন মিথ্যা গল্প বানিয়ে ময়মনসিংহ শহরের এক বাড়ীতে আশ্রয় নিয়েছিল।
উদ্ধারের পর দেখা যায়, নিস্পাপ ৮ মাসের শিশু আব্দুল্লাহ আল নোমানের বাম হাতের আঙ্গুলগুলো গরম পানিতে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে।
নিজের সন্তানতে ২৮ দিন পর ফিরে পেয়ে আবেগ্লাপ্লুত তার পিতা মাতা। শিশুটির মা আনন্দে আত্মহারা। তার চোখে আনন্দ অশ্রু। তারা শিশুটিকে উদ্ধার করে দেয়ায় পুলিশকে ধন্যবাদ জানান।
শিশুটির পিতা মোক্তার হোসেন বলেন, আমাদের সন্তানতে আমরা ফেরত পেয়েছি। আমরা খুবই খুশি। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া। পুলিশকেও ধন্যবাদ জানাই। তিনি বলেন, আসামীরা আমার ছেলেকে কিছুই খাওয়ায়নি। তাকে না খাইয়ে শুকিয়ে ক ঙ্কাল বানিয়ে ফেলেছে। বাম হাতের আঙ্গুল গরম পানিতে পুড়িয়ে দিয়েছে। আমার নিস্পাপ শিশুটিকে ময়মনসিংহ শহরে ফুটপাথে শুইয়ে রেখে আসামীরা ভিক্ষা করতো। আমরা এর বিচার চাই।
তিনি আরো জানান, তার স্ত্রী একটি পোশাক কারখানায় কাজ করেন। তিনি ইলেকট্রিশিয়ান হিসাবে কাজ করেন। তাদের ৩ সন্তানের মধ্যে বড় ছেলে মাদ্রাসায় ৫ম শ্রেণীতে পড়ে, মেজ মেয়ে দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ে।