গণবাণী ডট কম:
বিদায়ী মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে সেনেটের হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভ বা প্রতিনিধি পরিষদ গত সপ্তাহের ক্যাপিটলের দাঙ্গার ঘটনায় “বিদ্রোহে উস্কানি” দেয়ার কারণে অভিশংসন করেছে। দেশটির ইতিহাসে এই প্রথম কোনও প্রেসিডেন্টকে দ্বিতীয়বারের মত অভিশংসিত করা হলো।
দেশটির স্থানীয় সময় বুধবার প্রতিনিধি পরিষদে ট্রাম্পকে অভিশংসনের প্রস্তাব পাস হয়। তার নিজের দল রিপাবলিকান এর ১০ জন সদস্য ট্রাম্পের বিপক্ষে গিয়ে ভোট দিয়ে তাকে অভিশংসিত করে। ট্রাম্পের অভিশংসনের পক্ষে ২৩২ ভোট এবং বিপক্ষে ১৯৭ ভোট পড়ে।
তিনি যুক্তরাষ্ট্রের একমাত্র প্রেসিডেন্ট যিনি দুই বার অভিশংসিত হয়েছেন এবং কংগ্রেসের পক্ষ থেকে যাকে অপরাধ সংগঠনে জড়িত থাকার কারণে অভিযুক্ত করা হয়েছে।
মি. ট্রাম্প যিনি নিজেও একজন রিপাবলিকান, তিনি এখন সেনেটে বিচারের সম্মুখীন হবেন। দোষী সাব্যস্ত হলে তিনি আবারো ক্ষমতায় আসার সুযোগ চিরতরে হারাতে পারেন।
তবে তার মেয়াদ আরো এক সপ্তাহ বাকি থাকলেও তাকে এখনই হোয়াইট হাউজ ছাড়তে হচ্ছে না। কারণ এই সময়ের মধ্যে সেনেট আবার গঠন করা সম্ভব নয়।
গত নভেম্বরে জো বাইডেনের কাছে নির্বাচনে হেরে যাওয়ার পর আগামী ২০শে জানুয়ারি ক্ষমতা ছাড়তে হবে তাকে।
বুধবার অভিশংসনের ভোট হওয়ার আগে বেশ কয়েক ঘণ্টা ধরে বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয় ডেমোক্রেট নিয়ন্ত্রিত হাউজ অব রেপ্রেজেন্টেটিভসে। সেসময় ক্যাপিটলের ভেতরে এবং বাইরে ন্যাশনাল গার্ডের সশস্ত্র সেনারা পাহারা দিয়েছেন।
আগামী সপ্তাহে মি. বাইডেনের শপথ অনুষ্ঠানকে সামনে রেখে ওয়াশিংটন ডিসি এবং ৫০টি অঙ্গরাজ্যের সবকটিতে সশস্ত্র বিক্ষোভের পরিকল্পনা রয়েছে বলে ফেডারেল তদন্ত সংস্থা এফবিআই সতর্ক করেছে।
কংগ্রেসে ভোটের পর প্রকাশিত এক ভিডিওতে মি. ট্রাম্প তার অনুসারীদের শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু তিনি যে অভিশংসিত হয়েছেন সেই বিষয়টি উল্লেখ করেননি।
“সহিংসতা এবং ভাঙচুরের কোন জায়গা নেই আমাদের দেশে … আমার সত্যিকারের কোন সমর্থক কখনোই রাজনৈতিক সহিংসতাকে সমর্থন দেবে না,” খানিকটা মলিন এবং শান্ত কণ্ঠে তিনি এসব বলেন।
ট্রাম্পের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ কী?
অভিশংসনের অভিযোগ মূলত রাজনৈতিক, অপরাধমূলক নয়। প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে কংগ্রেসের অভিযোগে বলা হয়েছে যে, ৬ই জানুয়ারি হোয়াইট হাউসের বাইরে তিনি তার ভাষণের মাধ্যমে ক্যাপিটলে হঠাৎ হামলার মাধ্যমে দখলে নেয়ার ঘটনায় উস্কানি দিয়েছেন।
তিনি তার সমর্থকদেরকে “শান্তিপূর্ণভাবে এবং দেশপ্রেমের সাথে” নিজেদের আওয়াজ তোলার আহ্বান জানিয়েছিলেন। সেই সাথে যে নির্বাচন তার ভাষায় “কারচুপির শিকার হয়েছে” তার বিরুদ্ধে “ভয়ংকর লড়াইয়ের”ও আহ্বান জানিয়েছিলেন।
মি. ট্রাম্পের এমন বক্তব্যের জের ধরে তার সমর্থকরা ক্যাপিটলে জোর করে ঢুকে পড়ে, আইনপ্রণেতাদের অধিবেশন ও নির্বাচনের ফলাফলের আনুষ্ঠানিক অনুমোদন দেয়ার প্রক্রিয়া স্থগিত করে তাদেরকে নিরাপদ স্থানে সরে যেতে বাধ্য করে। পুরো ভবনে লকডাউন দেয়া হয় এবং এ ঘটনায় পাঁচ জন মারা যায়।
অভিশংসনের বিবৃতিতে বলা হয়েছে যে, মি. ট্রাম্প “বারবার মিথ্যা বক্তব্য দিয়ে এটা প্রতীয়মান করার চেষ্টা করেছেন যে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফলাফলে কারচুপি হয়েছে এবং তা গ্রহণযোগ্য নয়”।
এতে বলা হয়, এরপর তিনি বার বার একই দাবি তুলেছেন এবং “ইচ্ছাকৃতভাবে জনগণের সামনে বলে তাদেরকে উৎসাহিত করেছেন এবং এর কারণেই ক্যাপিটলে অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে” যা সহিংসতা এবং প্রাণহানিতে রূপ নিয়েছে।
“প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প চরমভাবে যুক্তরাষ্ট্র এবং এর সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর নিরাপত্তাকে বিপন্ন করেছেন, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার অখণ্ডতাকে হুমকির মুখে ফেলেছেন, ক্ষমতার শান্তিপূর্ণ হস্তান্তরকে বাধাগ্রস্ত করেছেন এবং সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখাকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিয়েছেন।”
গত সপ্তাহে ২০২০ সালের নির্বাচনের ফল এবং ট্রাম্পের হারকে মেনে নেয়ার বিপক্ষে ১৩৯ জন রিপাবলিকান ভোট দিয়েছেন।
বিতর্কে আইনপ্রণেতারা কী বলেছেন?
আইনপ্রণেতারা সেই একই চেম্বারে বসে ভোটের পক্ষে-বিপক্ষে বিতর্ক করেছেন যেখানে গত সপ্তাহে দাঙ্গাকারীদের প্রবেশের মুখে গ্যাস মাস্ক পরে তারা চেয়ার নিচে আশ্রয় নিয়েছিলেন।
হাউস স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি হাউস ফ্লোরে বলেন: “যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট এই সহিংস উত্থানকে উস্কে দিয়েছেন, আমাদের দেশের বিরুদ্ধে এই সশস্ত্র বিদ্রোহকে উৎসাহ দিয়েছেন।”
“তিনি অবশ্যই যাবেন। আমাদের ভালবাসার দেশের প্রতি তিনি স্পষ্ট এবং চলমান হুমকি।”
ডেমোক্রেটিক কংগ্রেসম্যান জুলিয়ান ক্যাস্ট্রো মি. ট্রাম্পকে “ওভাল অফিসের দায়িত্ব নেয়া সবচেয়ে বিপজ্জনক ব্যক্তি হিসেবে” উল্লেখ করেছেন।
বেশিরভাগ রিপাবলিকানই মি. ট্রাম্পের বক্তব্যের পক্ষে কোন সাফাই দেননি। এর পরিবর্তে তারা বলেছেন যে, অভিশংসনের প্রস্তাব প্রথাগত শুনানি ছাড়াই উত্থাপিত হয়েছে এবং জাতীয় ঐক্যের জন্য এটিকে বাদ দিতে ডেমোক্রেটদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তারা।
“এতো কম সময়ের মধ্যে প্রেসিডেন্টকে অভিশংসিত করাটা ভুল সিদ্ধান্ত হবে,” বলেন হাউসের শীর্ষ রিপাবলিকান নেতা কেভিন ম্যাককার্থি।
“তার মানে এই নয় যে প্রেসিডেন্টের কোন দোষ নেই। বুধবার কংগ্রেসের উপর দাঙ্গাকারীদের হামলার দায় প্রেসিডেন্টকে বহন করতে হবে।”
ওহাইয়ো রাজ্যের রিপাবলিকান জিম জর্ডান ডেমোক্রেটদের বিরুদ্ধে দেশকে বেপরোয়াভাবে রাজনৈতিক বিভাজনের দিকে ঠেলে দেয়ার অভিযোগ তোলেন।
“সব সময়ই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টকে নামাতে হবে” বলেন মি. জর্ডান। “যাই হোক না কেন, প্রেসিডেন্টকে সরাতে হবে। এটা একটা ঘোর হয়ে দাঁড়িয়েছে।”
প্রেসিডেন্টের দলের মধ্য থেকে যারা তার বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন থার্ড-র্যাং কিং হাউস রিপাবলিকান লিজ চেনি।
ওয়াইওমিং এর এই রিপ্রেজেন্টেটিভ সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট ডিক চেনির মেয়ে। তিনি ক্যাপিটলের দাঙ্গার কথা উল্লেখ করে বলেন, “এর আগে কোন প্রেসিডেন্ট এতো বড় বেইমানি করেনি।”
পরবর্তী পদক্ষেপ কী?
অভিশংসনের আর্টিকেলটি সেনেটে যাবে যেখানে প্রেসিডেন্ট দোষী কিনা তার বিচার অনুষ্ঠিত হবে।
মি. ট্রাম্পের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণের জন্য দুই-তৃতীয়াংশ ভোট দরকার হবে। তার মানে হচ্ছে ১০০ আসনের উচ্চ কক্ষে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে অন্তত ১৭ জন রিপাবলিকানকে ডেমোক্রেটদের পক্ষে ভোট দিতে হবে।
মঙ্গলবার নিউ ইয়র্ক টাইমস এক প্রতিবেদনে বলেছে যে, কম করে হলেও ২০ জন রিপাবলিকান প্রেসিডেন্টের বিচার চায়।
মি. ট্রাম্প যদি সেনেটে দোষী সাব্যস্ত হন তাহলে আইনপ্রণেতারা চাইলে আরেকটি ভোট অনুষ্ঠিত করতে পারেন যা তাকে ২০২৪ সালে আবারো প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশ নেয়ার পথকে বন্ধ করে দেবে।
তবে এই বিচার কাজ মি. ট্রাম্প ক্ষমতায় থাকার সময় অর্থাৎ আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে অনুষ্ঠিত হবে না।
এক বিবৃতিতে রিপাবলিকান সেনেট নেতা মিচ ম্যাককনেল বলেন: “সব নিয়ম, প্রক্রিয়া এবং সেনেট যেখানে প্রেসিডেন্টের বিচার অনুষ্ঠিত হবে তার নজির অনুযায়ী, আগামী সপ্তাহে প্রেসিডেন্ট-ইলেক্ট বাইডেন শপথ নেয়ার আগে একটি নিরপেক্ষ বা গুরুতর বিচার কোনভাবেই অনুষ্ঠিত করা সম্ভব হবে না।”
তিনি বলেন, এর চেয়ে যদি বাইডেন প্রশাসনের জন্য একটি শান্তি ও সুশৃঙ্খল ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়া নিশ্চিত করা যায়, তাহলে সেটিই জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করবে।
মি. ম্যাককনেল তার সহকর্মীদের এক নোটের মাধ্যমে জানিয়েছেন যে তিনি কিভাবে ভোট দেবেন সেটি এখনো ঠিক হয়নি।
এখনো পর্যন্ত কোন মার্কিন প্রেসিডেন্ট অভিশংসনের মাধ্যমে ক্ষমতা থেকে অপসারিত হননি। ২০১৯ সালে হাউসে অভিশংসিত হয়েছিলেন মি. ট্রাম্প। কিন্তু সেনেটে পার পেয়ে যান তিনি। একই ধরণের ঘটনা ১৯৯৮ সালে বিল ক্লিনটনের সাথে এবং ১৮৬৮ সালে অ্যান্ড্রু জনসনের সাথে ঘটেছিল।
এদিকে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ট্রাম্পের অভিশংসন নিয়ে এখন পর্যন্ত কোন মন্তব্য করেননি।
দেশটির গোয়েন্দা সংস্থা এফবি আই সর্তক করে জানিয়েছে, বাইডেনের শপথ অনুষ্ঠান ঘিরে ওয়াশিং টন এবং ৫০ টি রাজ্যে সশস্ত্র বিক্ষোভ হতে পারে। খবর : বিবিসি, এনডিটিভি।