গণবাণী ডট কম:
ভারতের আসামের বৈধ নাগরিকদের তালিকা চুড়ান্ত করা এবং কথিত অবৈধ অভিবাসীদের চিহ্নিত করার উদ্দেশ্যে নাগরিকপঞ্জি বা এনআরসির চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশিত হয়েছে। শনিবার স্থানীয় সময় সকাল ১০টার পর এ তালিকা প্রকাশ করা হয়। এই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন ৩ কোটি ১১ লক্ষ মানুষ। বাদ পড়েছেন ১৯ লক্ষ। তবে বাদপড়া ব্যাক্তিগণ আপিল করতে পারবেন।
তালিকা প্রকাশ কে কেন্দ্র করে শনিবার সকাল থেকেই অসমজুড়ে নেমে আসে আশঙ্কা আর উদ্বেগের ছায়া। একটা প্রশ্নই ঘুরে বেড়াতে থাকে, চূড়ান্ত তালিকায় নাম থাকবে তো? শনিবার সকাল ১০টায় অসমের নাগরিকপঞ্জির (এনআরসি) চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ হয়। ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চ অর্থাৎ বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগের সময় পর্যন্ত যারা আসামে বসবাস করেছেন বা ছিলেন, ভারতের নাগরিক হওয়ার ভিত্তি ধরা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর দ্বিতীয় মেয়াদে জম্মু ও কাশ্মীরের কয়েক দশক পুরাতন স্বায়ত্তশাসন ও মর্যাদা কেড়ে নেয়ার মাত্র কয়েক সপ্তাহ পরে এনআরসি আরেকটি অন্যতম বৃহত্তম পদক্ষেপ হিসাবে দেখা হচ্ছে। যা কিনা বিজেপির দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক অভিলাষ ছিল। এনআরসি প্রকাশের পর বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য জুড়ে কয়েক হাজার আধাসামরিক বাহিনী এবং পুলিশ মোতায়েন করে আসামে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। তালিকার প্রকাশের শুর থেকে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে এবং বেশ কয়েকটি সরকারী স্থানে চার জনেরও বেশি লোকের জমায়েত নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বিশেষত সংবেদনশীল অঞ্চলে যা মূল শহর গুয়াহাটিসহ কয়েকটি এলাকা যেখানে অতীতে সহিংসতা হয়েছিল। প্রায় ৬০ হাজার পুলিশ সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে এবং কেন্দ্র থেকে ২০ হাজার অতিরিক্ত আধাসামরিক বাহিনী আসামে প্রেরণ করা হয়েছে।
এনআরসির আগে পরে:
বাংলাদেশ থেকে আসা তথাকথিত অবৈধ অভিবাসীদের ইস্যুটি বেশ পুরনো। আসামের ন্যাশনাল রেজিস্টার অফ সিটিজেনস বা এনআরসির প্রথম তালিকাটি প্রকাশিত হয় ১৯৫১ সালে। সেটা ছিল ভারত ভাগের চার বছর পরের ঘটনা। তখন তৎকালীন পূর্ববঙ্গ পাকিস্তানের অংশ হওয়ার পর কিছু লোক সীমান্ত অতিক্রম করে নবগঠিত ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন। বিপুল সংখ্যক মুসলমানদের আগমন হিন্দু-প্রধান আসামের জনসংখ্যার ভারসাম্যকে বদলে দিতে পারে এই আশঙ্কায় সেখানকার অসমীয়া জাতীয়তাবাদী দলগুলো আন্দোলন শুরু করে এবং নাগরিকত্বের প্রথম তালিকাটি তৈরি হয়। ১৯৭০-এর দশকে এই সমস্যা আবার দেখা দেয় যখন বাংলাদেশে পাকিস্তানের কাছ থেকে স্বাধীনতার লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। সে সময় লক্ষ লক্ষ মানুষ পালিয়ে ভারতে চলে যায়। এদের একাংশ আসামে আশ্রয় নেয়।
অল আসাম স্টুডেন্টস ইউনিয়ন (আসু) ১৯৭৯ সালে অবৈধ অভিবাসীদের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে। ১৯৮৩ সালে এই আন্দোলন সহিংস রূপ নেয় যাতে ২০০০ সন্দেহভাজন অবৈধ অভিবাসী প্রাণ হারান। এদের বেশিরভাগই ছিলেন মুসলমান। আসু এবং কয়েকটি আঞ্চলিক দল এই প্রশ্নে শেষ পর্যন্ত ১৯৮৫ সালে রাজীব গান্ধীর নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে একটা চুক্তিতে আসে। চুক্তিতে বলা হয়, ১৯৭১ সালের ২৪শে মার্চ আগে থেকে আসামের বাসিন্দা কেউ এমনটা প্রমাণ করতে না পারলে তাকে ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেয়া হবে এবং তাকে অবৈধ অভিবাসী হিসেবে বিবেচনা করা হবে।
কিন্তু চুক্তিটি কখনই বাস্তবায়ন করা হয়নি।
২০০৯ সালে অভিজিৎ শর্মা নামে এক ব্যক্তি ভারতের সুপ্রিম কোটের কাছে এক পিটিশন দায়ের করেন এবং এনআরসি তালিকা হালনাগাদ করার আবেদন করেন। ২০১৪ সালে আদালত ঐ তালিকা ২০১৬ সালের ৩১শে জানুয়ারির মধ্যে হালনাগাদ করার জন্য কেন্দ্র সরকারকে আদেশ দেয়।
সে অুনযায়ী ১৯৭১ সালের ২৪শে মার্চের আগে থেকে আসামে বসবাস করছেন, যারা এটি প্রমাণ করতে পেরেছেন, তাদের নাম এনআরসিতে রয়েছে। নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্য রাজ্যের সব অধিবাসীকে তাদের জমির দলিল, ভোটার আইডি এবং পাসপোর্টসহ নানা ধরনের প্রমাণপত্র দাখিল করতে হয়েছিল। যারা ১৯৭১ সালের পর জন্মগ্রহণ করেছেন তাদের প্রমাণ করতে হয়েছে যে তাদের বাবা-মা কিংবা তাদের বাবা-মা ঐ তারিখের আগে থেকেই আসামের বাসিন্দা। তিন কোটি ২০ লক্ষ মানুষের দলিলপত্র যাচাই করার সম্পন্ন করে সরকার ২০১৭ সালের ডিসেম্বর মাসে প্রথম খসড়া তালিকা প্রকাশ করে। যাচাই বাছাইয়ের পর ঐ খসড়ার দ্বিতীয় তালিকাটি প্রকাশিত হয় ২০১৮ সালের ৩০শে জুলাই। খসড়া তালিকা অনুযায়ী, রাজ্যের মোট তিন কোটি ২৯ লক্ষ বাসিন্দা তাদের নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে সমর্থ হন। কিন্তু ৪০ লক্ষ মানুষ এই তালিকা থেকে বাদ পড়ে যান। এরপর নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্য তাদের কাছ থেকে অতিরিক্ত কাগজপত্র চাওয়া হয় এবং ৩৬ লক্ষ ২০ হাজার মানুষ তালিকায় নাম ওঠানোর জন্য দলিলপত্র জমা দেন। তারপর চূড়ান্ত তালিকাটি ৩১শে অগাস্ট প্রকাশিত হয়েছে। খবর : বিবিসি, এনডিটিভি, আনন্দবাজার পত্রিকার।
এনআরসি কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ উঠেছে যে তালিকা থেকে বাদ পড়া বহু লোকের কাছে তারা চিঠি পাঠিয়েছে এবং কাছের অফিস বাদ দিয়ে বহু দূরের অফিসগুলোতে গিয়ে তাদের কাগজপত্র জমা দেয়ার নির্দেশ দিয়েছে। নাগরিকত্ব নিয়ে অনিশ্চয়তার চাপ নিতে না পেরে অনেকেই আত্মহত্যা করেছে। আসামের প্রতিষ্ঠান সিটিজেন ফর জাস্টিস অ্যান্ড পিস-এর নেতা জামির আলী বলছেন, ‘মানসিক আঘাত ও চাপ’ সইতে না পেরে আসামে ৫১ ব্যক্তির আত্মহত্যার তথ্য তাদের হাতে রয়েছে। বেশিরভাগ আত্মহত্যা ঘটনা ঘটেছে ২০১৪ সালের জানুয়ারি মাসের পর, যেসময়ে নাগরিক তালিকার প্রথম খসড়াটি প্রকাশিত হয়েছিল।
ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, সমস্ত লোকাল আইনী বিকল্প শেষ না হওয়া পর্যন্ত যাদের নাম চূড়ান্ত এনআরসিতে নেই, তাদের বিদেশি ঘোষণা করা যাবে না। এনআরসির বাইরে থাকা প্রতিটি ব্যক্তি বিদেশি ট্রাইব্যুনালে আবেদন করতে পারে এবং আপিল দায়ের সময়সীমা ৬০ থেকে ১২০ দিনে বাড়ানো হয়েছে। আপীল শোনার জন্য পর্যায়ক্রমে কমপক্ষে এক হাজার ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হবে; ১০০ টি ট্রাইব্যুনাল ইতিমধ্যে উন্মুক্ত এবং আরও ২০০টি সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে স্থাপন করা হবে। ট্রাইব্যুনালে কেউ মামলা হারলে উচ্চ আদালত এবং তারপরে সুপ্রিম কোর্টের কাছে যেতে পারেন। সকল আইনী বিকল্প শেষ না হওয়া পর্যন্ত কাউকে আটক কেন্দ্রে রাখা হবে না বলে সরকার জানিয়েছে।
আসামের মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সোনোয়াল বলেছেন “যতক্ষণ পর্যন্ত আবেদন থাকবে ততক্ষণ কাউকে বিদেশী বলে গণ্য করা হবে না। কারণ কোনও ব্যক্তিকে বিদেশী বলে ঘোষণা করার ক্ষমতা কেবল বিদেশীদের ট্রাইব্যুনালেই থাকে।”
আসাম নিয়মিতভাবে বন্যার শিকার হয়। একারণে বহু পরিবারের সরকারি কাগজপত্র নষ্ট হয়েছে। দলিলপত্র সংরক্ষণের দুর্বলতা, অশিক্ষা এবং অর্থ না থাকায় মামলা করতে পারেনি বহু পরিবার। তাই আপীলে কতজন টিকবে তা নিয়ে অনিশ্চয়তা থেকেই গেল।
সহিংসতার আশঙ্কা :
স্থানীয় হিন্দুরা বিপুলভাবে এনআরসির সমর্থক। কিন্তু স্থানীয় মুসলমানরা এনিয়ে কিছুটা নীরব। কারণ তাদের ভয় এ নিয়ে মুখ খুললে তাদেরও বাংলাদেশী হিসেবে চিহ্নিত করা হতে পারে। আর তাদের এই আশঙ্কার মূলে রয়েছে আসামের হিন্দু জাতীয়তাবাদী সরকার প্রধানের বক্তব্য যেখানে তিনি খোলাখুলিভাবে বলেছেন যে তিনি মুসলমান অভিবাসীদের চেয়ে হিন্দু অভিবাসীদের প্রাধান্য দেবেন। তাই যাদের নাম বাদ পড়েছে তাদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে। আসাম সরকার তালিকার বাইরে থাকা লোকেদের ধর্মীয় পরিচয়ের তথ্য প্রকাশ না করলেও ধারণা করা হচ্ছে এদের বেশিরভাগই বাংলা-ভাষী মুসলমান। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির একটা সম্ভাবনা রয়েছে। পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য রাজ্য সরকার বন্দি শিবির তৈরি করছে, কথিত অবৈধ অভিবাসীদের জন্য শত শত ট্রাইবুনাল গঠন করছে এবং যারা বিদেশি হিসেবে চিহ্নিত হবেন তাদের একটি কেন্দ্রীয় ডেটাবেজ তৈরি করছে। বিবিসির সংবাদদাতা নিতিন শ্রীবাস্তব জানাচ্ছে, “সব আপিল এবং চ্যালেঞ্জ দূর হওয়ার পর এই তালিকাকে কেন্দ্র করে সহিংসতা শুরু হতে পারে।” “আর সেটা শুরু হবে যখন এরা তাদের জমি, ভোটের অধিকার এবং মুক্তির প্রশ্নে তারা উদ্বিগ্ন হয়ে উঠবে।”