গণবাণী ডট কম:
গাজীপুর মহানগরীর জয়দেবপুর রেল জংশনের আউটার সিগন্যালে যাত্রীবাহী ট্রেন ও তেলবাহী ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষের ২৪ ঘন্টা পেরিয়ে গেলেও এখনো শেষ হয়নি উদ্ধার কাজ। সংশ্লিষ্ঠরা বলছেন, উদ্ধার কাজ শেষ হতে আর সারাদিন লেগে যেতে পারে।
রেল বিভাগ ও স্থানীয়রা জানায়, ঢাকা-জয়দেবপুর অংশে ডুয়েল গেজ ডাবল লাইনের মধ্যে ডাউন লাইনে শুক্রবার বেলা ১১টার দিকে তেলবাহী ট্রেন ঢাকা থেকে রংপুরের দিকে যাচ্ছিল। একই সময়ে আপ লাইনে জয়দেবপুর রেল স্টেশন থেকে ঢাকাগামী টাঙ্গাইল কমিউটার ট্রেন যাত্রা করে। কমিউটার ট্রেনটি আউটার সিগনালে আপ লাইন ছেড়ে ডাউন লাইনে ঢুকে পড়ে। ট্রেনটির অর্ধেক অংশ আপ লাইনে প্রবেশ করার সময় বিপরীত দিক থেকে আসা রংপুরগামী তেলবাহী ট্রেনের সাথে মুখোমুখি সংঘর্ষ ঘটে। এ সময় বিকট শব্দে আশপাশের মাটি কেঁপে ওঠে। এতে টাঙ্গাইল কমিউটার ট্রেনের ইঞ্জিনসহ চারটি এবং তেলবাহী ট্রেনের ইঞ্জিনসহ তিনটি বগি লাইনচ্যুত হয়। কয়েকটি বগি ধুমড়ে মুচড়ে যায়। কিন্তু টাঙ্গাইল কমিউটার ট্রেনটি যাত্রী বিহীনভাবে ঢাকা ফিরছিল, একারণে কোন যাত্রী হতাহত হয়নি। এ ঘটনায় দুটি ট্রেনের লোকো মাস্টারসহ ৪ জন আহত হয়।
আহতরা হলেন লোকোমাস্টার শরীফ মাহমুদ (৩৮), লোকোমাস্টার হাবিবুর রহমান (৫৮) ও সহকারী লোকোমাস্টার সবুজ হাসান (৪৬)। তাঁদের উদ্ধার করে গাজীপুরের শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে। অপরজনকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়।
দুর্ঘটনার এক ঘণ্টা পর ঢাকা থেকে উদ্ধারকারী ট্রেন ঘটনাস্থলে আসে। পরে আখাউড়া থেকে একটি ক্রেন ও উদ্ধার কাজে যোগ দেয়। তারা টাঙ্গাইল কম্পিউটার ট্রেনের ক্ষতিগ্রস্ত বগিগুলো রেখে ভালো বগিগুলো পেছনের দিকে টেনে জয়দেবপুর রেল জংশনের এক নং প্লাটফর্মে রাখে। সংঘর্ষের পর এই পথে প্রায় ২ ঘন্টা রেল যোগাযোগ বন্ধ থাকার পর বেলা ১টার দিকে ট্রেন যোগাযোগ শুরু হয়।
অপরদিকে, ঘটনা তদন্তে গাজীপুর জেলা প্রশাসন একটি এবং রেল বিভাগ পৃথক দুইটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। ভুল সংকেতের কারণে দুটি ট্রেন এক লাইনে চলে আসে বলে প্রাথমিক ধারণা থেকে রেলওয়ের তিন কর্মচারীকে বরখাস্ত করেছে কর্তৃপক্ষ। তাঁরা হলেন, জয়দেবপুর রেলওয়ে জংশনের ঘুমটি ঘরের মাস্টার মো. হাসেম, পয়েন্টসম্যান সাদ্দাম হোসেন ও মোস্তাফিজুর রহমান।
শনিবার বেলা এগারোটার দিকে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, এখনো ঘটনাস্থলে দুটি ট্রেনের ইঞ্জিন মুখোমুখি সংঘর্ষের অবস্থাতেই রয়েছে। উদ্ধারকারী ইতিমধ্যে তেলবাহী ট্রেনের একটি বগি ব্যতীত অন্য বগিগুলো উদ্ধারকারী ট্রেনের সাহায্যে পিছনের দিকে গাজীপুর মহানগরীর ধীরাশ্রম রেল স্টেশনে নিয়ে রাখা হয়েছে। অবশিষ্ট বগিটিও টেনে ধীরাশ্রমে নিয়ে রাখা হবে। টাঙ্গাইল কম্পিউটার ট্রেনের তিনটি বগি মারাত্মক রকম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এরমধ্যে দুটি বগি একটি ভিতরে অপরটি ঢুকে গিয়েছিল। এ বগিগুলো রেললাইন থেকে সরিয়ে পাশের নীচু ভূমিতে রেখে দেওয়া হয়েছে।
উদ্ধারকার কাজে অংশ নিতে ক্রেনের ক্রেনম্যান আবুল হোসেন বলেন, ক্রেন দিয়ে লাইনচ্যুত হওয়া বগিগুলো লাইনের উপর তোলা হয়। পরে যেগুলো সচল করা সম্ভব ছিল, সেগুলো টেনে বগিগুলো জয়দেবপুর রেল স্টেশনে এবং তেলের কন্টেইনারবাহী বগিগুলো ধীরাশ্রম রেল স্টেশনে নিয়ে রাখা হয়েছে। উদ্ধার কাজ শেষে ক্রেনটি আখাউড়া ফিরে যাবে। আর তেলের বগিগুলো ধীরাশ্রম রেল স্টেশনে রাখার পর দুর্ঘটনাকবলিত দুটি ট্রেনের ইঞ্জিন একসাথে টেনে ঢাকার কমলাপুর নিয়ে যাওয়া হবে। পরে সেখান থেকে এগুলো চট্টগ্রাম ওয়ার্কশপে পাঠানো হবে।
তিনি আরো বলেন, এসব কাজ শেষ করতে আজকে সারাদিন লেগে যাবে। কাজ শেষ করে আমরা লাইন ক্লিয়ার করার পর ঢাকা জয়দেবপুর-ডুয়েল গেজ ডাবল লাইনের বন্ধ থাকা লাইনে রেল চলাচল শুরু হবে।
জয়দেবপুর রেলওয়ে স্টেশন মাস্টার হানিফ আলী জানান, টাঙ্গাইল কমিউটার ট্রেনটি বেলা ১১টায় জয়দেবপুর স্টেশনে যাত্রাবিরতি শেষে ঢাকার উদ্দেশে যাত্রা করে। ট্রেনটি স্টেশন থেকে ছেড়ে আউটার সিগন্যালে পৌঁছানোর পর লাইন ক্রসিং করার সময় বিপরীত দিক থেকে আসা একটি তেলবাহী ট্রেনের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়।
হানিফ আলী আরও জানান, দুর্ঘটনার পর ময়মনসিংহ ও উত্তরাঞ্চলের সঙ্গে ট্রেন যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। পরে ঢাকা থেকে উদ্ধারকারী ট্রেন ঘটনাস্থলে এসে পৌঁছায়। উদ্ধার শেষে প্রায় দুই ঘণ্টা পর ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক হয়।
দুর্ঘটনার পর ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে গাজীপুরের জেলা প্রশাসক আবুল ফাতে মোহাম্মদ সফিকুল ইসলাম জানান, ভুল সিগন্যালের কারণে এই দুর্ঘটনা ঘটেছে। টাঙ্গাইল কমিউটার ট্রেনটি খালি অবস্থায় ঢাকার দিকে যাচ্ছিল। অন্যদিকে তেলবাহী ট্রেনটি যাচ্ছিল রংপুরে। এ সময় যাত্রীবাহী ট্রেনটি তেলবাহী ট্রেনের লাইনে ঢুকে পড়লে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।
আবুল ফাতেহ মো. সফিকুল আরও বলেন, দুর্ঘটনায় কারও কোনো গাফিলতি বা অবহেলা ছিল কি না, তা জানতে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মতিউর রহমানের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। আগামী দুই কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে কমিটিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
ঢাকা বিভাগীয় রেলওয়ে ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ শফিকুর রহমান জানান, রেলওয়ের পক্ষ থেকেও দুটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। এর মধ্যে সিওপিএস মো. শহীদুল ইসলামকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের আঞ্চলিক কমিটি করা হয়েছে। আর রেলওয়ের ঢাকা বিভাগীয় প্রকৌশলী (সিগন্যাল ও টেলিকমিউনিকেশন) সৌমিক শাওন কবিরকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের আরেকটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। দুই কমিটিকে তিন কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। তদন্তের পর দুর্ঘটনার সঠিক কারণ জানা যাবে।