গণবাণী ডট কম:
ভারতের আসামের বৈধ নাগরিকদের তালিকা চুড়ান্ত করা এবং কথিত অবৈধ অভিবাসীদের চিহ্নিত করার উদ্দেশ্যে নাগরিকপঞ্জি বা এনআরসির বিতকির্ত চূড়ান্ত তালিকা শনিবার প্রকাশিত হয়েছে। এই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন ৩ কোটি ১১ লক্ষ মানুষ। চূড়ান্ত তালিকায় ১৯ লাখ ৬ হাজার ৬৫৭ জনের নাম বাদ পড়েছে।। এ তালিকাকে কেন্দ্র করে আসাম জুড়ে বিরাজ করছে আশঙ্কা আর উদ্বেগের ছায়া। প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে পড়ে বাদ পড়ে যাওয়া মানুষের নাগরিকত্ব৷ আসামে বসবাসকারী ‘ভারতীয়’ পরিবারের সংখ্যা স্পষ্টভাবে বোঝা যায় না৷ এমন দেখা যায়, কোনো পরিবারের সন্তান তালিকার বাইরে, অথচ মা-বাবা দু’জনই তালিকায় বর্তমান৷ অথবা স্বামীর নাম তালিকায় রয়েছে, কিন্ত তাঁর স্ত্রী বা তাঁদের সন্তান অনুপস্থিত৷ প্রশ্ন ওঠে, কারা এই ১৯ লক্ষ মানুষ, যাঁদের ঠাই মেলেনি নাগরিকপঞ্জির তালিকায়? কী-ই বা তাঁদের ভবিষ্যৎ?
নাগরিকপঞ্জি সমণ্বয়কের পক্ষে কোনো স্পষ্ট ধারণা না পাওয়া গেলেও তালিকা-বহির্ভূত মানুষেরা বেশিরভাগই বাংলাভাষী৷ কিন্তু তালিকার বাইরে থেকে গেছেন এমন অসমীয়া, বোড়ো, পাঞ্জাবী বা ডিমাসাভাষী মানুষেরাও আছেন৷ চোখে পড়ার মতো সংখ্যায় তালিকার বাইরে রয়ে গেছেন মহিলারা, যারা বিবাহসূত্রে আসাম-নিবাসী৷
এমনিভাবে বিতর্কিত তালিকা থেকে বাদ পড়েছেন ভারতের সেনা বাহিনীর সাবেক সেনা কর্মকর্তা মোহাম্মদ সানাউল্লাহ, আসামের দ্বিতীয় শক্তিশালী বিরোধী দলের বিধান সভার সদস্য অনন্ত কুমার মালো, স্বামী সন্তান নিয়ে বসবাসকারী গৌহাটির গৃহবধূ জমিরন পারভিনসহ ১৯ লাখ মানুষ।
হিন্দুস্তান টাইমসের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চূড়ান্ত তালিকা থেকে বাদ পড়েছেন কারগিল যুদ্ধে অংশ নেওয়া সাবেক ভারতীয় সেনা কর্মকর্তা মোহাম্মদ সানাউল্লাহ। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ভারতীয় সেনাবাহিনীতে জুনিয়র কমিশনড অফিসার (জেসিও) হিসেবে কর্মরত ছিলেন। অংশ নিয়েছেন কারগিল যুদ্ধে। যুদ্ধক্ষেত্রে অবদানের জন্য রাষ্ট্রপতি পদকেও ভূষিত হয়েছেন তিনি। এনআরসির চূড়ান্ত তালিকায় মোহাম্মদ সানাউল্লাহর তিন সন্তান, দুই মেয়ে ও এক ছেলের নাম না থাকলেও রয়েছে স্ত্রীর নাম। প্রতিবেদনে আরও জানানো হয়, সানাউল্লাহ ও তার সন্তানদের বিরুদ্ধে ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালের রায় গুয়াহাটি হাইকোর্টে বিচারাধীন রয়েছে। তাই এনআরসির ধারা অনুযায়ী চূড়ান্ত নাগরিক তালিকায় তাদের নাম অন্তর্ভুক্তি করা হয়নি। এর আগে, ২০০৮ সালে সন্দেহজনক ভোটার হিসেবে সানাউল্লাহর নাম তালিকাভুক্ত হয়। এমনকি আসামের এক সরকারি কর্মকর্তা তাকে বিদেশি আখ্যায়িত করে একটি প্রতিবেদনও তৈরি করেন। ওই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ২০১৮ সালে তার বিরুদ্ধে ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালে মামলা হলে একই বছরে ২৩ মে বিদেশী হিসাবে চিহ্নিত করে গোয়ালপাড়ার একটি বন্দিশিবিরে তাকে পর্যন্ত ১১ দিন আটকে রাখা হয়েছিল।পরে গুয়াহাটি হাইকোর্ট থেকে তিনি জামিন পান।
বিবিসির প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, শনিবার দুপুরে যখন জানতে পারেন, চূড়ান্ত নাগরিক তালিকা বা এনআরসিতে তার নাম নেই গৌহাটির গৃহবধূ জমিরন পারভিনের। এটি জানার পর আতঙ্কে আর অনিশ্চয়তায় মুষড়ে পড়েছেন তিনি। শনিবার দুপুরের দিকে গৌহাটিতে তাদের বাড়িতে গিয়ে বিবিসির সাংবাদিক দেখতে পান, কিছুক্ষণ পরপরই চোখ মুছছেন জমিরন পারভিন। স্বামী আজম আলী মৃধা এবং শ্বশুর বাড়ির অন্যান্যরা তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন। আট-নয় বছরের একমাত্র ছেলে বাচ্চাটি উদ্বিগ্ন হয়ে মাকে দেখছে। স্বামী-সন্তান এবং শ্বশুর বাড়ির সবারই চূড়ান্ত তালিকায় নাম রয়েছে। বাবার পরিবারের সবাই তালিকায় রয়েছেন। বাদ পড়েছেন একমাত্র তিনি। জমিরন বলেন, “খসড়া তালিকায় নাম না ওঠার পর সব সমস্ত কাগজ-পত্র দিয়ে আপিল করেছিলাম। কিন্তু তারপরও নাম নেই। জানিনা এখন আমার কি হবে।” জমিরনের জন্ম আসামের বড়পেটায়। কিন্তু মাধ্যমিক পরীক্ষার প্রবেশপত্রে জমিরনের বাবার নামের বানান ভুল লেখা হয়েছিল বলেই এই পরিণতি। তার বাবার নাম আতব আলী, কিন্তু পরীক্ষার প্রবেশপত্রে নাম লেখা হয় আতাবর আলী। আর এই দুই অক্ষরের ভুলেই চরম অনিশ্চয়তায় পড়ে গেছেন এই নারীর। জমিরনের স্বামী জানালেন, তারা ট্রাইবুনালের আপিল করবেন।
বাদ পড়াদের তালিকায় রয়েছেন আসামের দ্বিতীয় শক্তিশালী বিরোধী দলের এক বিধান সভার সদস্যের। ওয়েবসাইটে নিজের নাম দেখতে পাননি অল ইন্ডিয়া ইউনাইটেড ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্টের (এআইইউডিএ) অনন্ত কুমার মালো।
বিতর্কিত এ তালিকার বিষয়ে আসামের শিলচরে জন্মগ্রহণ করা বর্তমানে শিলঙে কর্মরত গবেষক রম্যানি চক্রবর্তী বলেন, ‘‘নাগরিকপঞ্জিতে নাম নথিভুক্ত হওয়ার সময়ের খবর অনুযায়ী, বাঙালি অধ্যুষিত অঞ্চলে নথিপত্র পরীক্ষার কড়াকড়ি অনেকাংশে বেশি ছিল৷ এর মূল কারণ সম্ভবত বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী থিওরি, যা আসামের রাজনীতির দীর্ঘদিনের সঙ্গী৷ বেশি সমস্যার সম্মুখীন হবেন গরিব মানুষেরা৷”
সাবেক আসামবাসী সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব শুভপ্রসাদ নন্দী মজুমদারের মতে, ‘‘নাগরিকপঞ্জি অবৈধ না হলেও অন্যায়ে ভরপুর এবং এই সম্পর্কিত ঘটনাবলী আপাতত অত্যন্তজটিল এবং ঘোলাটে৷ পঞ্জির সমণ্বয়ক প্রতীক হাজেলা এবং সুপ্রিম কোর্টের মধ্যে অমিল থাকায় ‘স্ট্যান্ডার্ড অফ প্রসিডিওর’ নিয়েও যথেষ্ট অস্পষ্টতা দেখা দিয়েছে৷” কিন্ত ভাষিক-ধর্মগত সংখ্যালঘু, অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল মানুষ এবং বিবাহিত নারীদের ওপর দিয়েই যে নাগরিকত্ব প্রমাণের ঝড় বইবে, সেই বিষয়ে তিনিও একমত৷
আসামের একটি দৈনিক পত্রিকায় কর্মরত সাংবাদিক বিপ্লব রায়চৌধুরী জানান, ‘‘অসমের জ্বলন্ত বিদেশি সমস্যার সমাধান করতেই কংগ্রেস আমলে শুরু হয় নাগরিকপঞ্জি উন্নিতকরণের কাজ৷ কিন্তু বিদেশি বিতাড়নের নামে আসল ভারতীয় নাগরিকদের নিয়ে ছেলে-খেলা শুরু করেছে বর্তমান নাগরিকপঞ্জি কর্তৃপক্ষ৷ বাদপড়াদের ভাষা বা ধর্ম কী? পঞ্জিছুটদের সিংহভাগই যে ভারতীয়, তা হলফ করে বলা যায়৷ এর মধ্যে বাঙালি, হিন্দিভাষী, নেপালি, এমন কি খিলঞ্জীয়া অসমিয়াও রয়েছেন৷ তাছাড়া আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে অধিকাংশ মানুষকে তাদের নাম না থাকার কোনো কারণই দেখানো যায়নি৷ ‘টেকনিকাল এরর’, ‘নো রিজন’ ইত্যাদি শব্দবন্ধ খাতায় কলমে উঠে আসছে৷ ফলে একটা বিষয় নিশ্চিত যে, এর পেছনে একটা চক্রান্ত কাজ করছে৷ হয়ত কিছু উগ্রজাতীয়তাবাদী সংগঠনকে খুশি করতেই কিছু বিশেষ ভারতীয়ের গায়ে বিদেশির তকমা সাঁটা হচ্ছে৷” তিনি আরো বলেন, সব মিলিয়ে সর্বোচ্চ আদালতের শুনানি ছাড়াও, বর্তমানে নাগরিকপঞ্জি বিষয়ে রয়ে যাচ্ছে মূলত তিনটি প্রশ্ন৷ প্রথমত, কবে শুরু হবে সংশোধন প্রক্রিয়া এবং আদৌ কি চলতি বছরের শেষে প্রকাশ পাবে আসামের সম্পূর্ণ নাগরিক তালিকা? দ্বিতীয়ত, এত কাঠখড় পুড়িয়ে সম্পূর্ণ হওয়া নাগরিকপঞ্জির মূল কর্তব্য ঠিক কী? কোন খাতে ব্যবহৃত হবে নাগরিক সম্বন্ধিত তথ্যাবলী? এবং সর্বোপরি, পঞ্জি-বহির্ভূত মানুষদের ভবিষ্যৎ কী? তর্কের খাতিরে যদি ধরে নিই যে, মানুষগুলো সত্যিই বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী, তাহলে অপর্যাপ্ত ডিটেনশন ক্যাম্প এবং বাংলাদেশের সাথে কোনো প্রত্যর্পন চুক্তি না থাকায় এ মানুষের আগামী ঠিকানা কি তবে ‘নো ম্যানস ল্যান্ড’?
এখন বড় প্রশ্ন হচ্ছে এই ১৯ লাখ বাংলাভাষী মানুষের, যাদের সিংহভাগই মুসলমান, এখন কী হবে।
তারা কি রাষ্ট্রহীন হয়ে পড়লেন? এখনই সেটা তারা হচ্ছেন না। বাদ পড়া এই মানুষদের আপিলের জন্য ১২০ দিন সময় দেওয়া হয়েছে। বিশেষভাবে তৈরি ট্রাইবুনাল ছাড়াও তারা হাইকোর্ট বা সুপ্রিম কোর্টেও আপিল করতে পারবেন।
তবে ভারতের সমস্ত আদালতগুলো এমনিতেই সারা বছরই মামলার চাপে পর্যুদস্ত। ফলে আদালতে গিয়ে দীর্ঘ, জটিল এবং ব্যয়বহুল আপিল প্রক্রিয়ার সুবিধা কতজন নিতে পারবেন তা নিয়ে পর্যবেক্ষকদের মধ্যে বিস্তার সন্দেহ রয়েছ। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের দরিদ্র, অল্প শিক্ষিত বা নিরক্ষর মানুষগুলোর জন্য এই আপিল প্রক্রিয়ায় ঢোকা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে।
ফলে যারা আপিলে অসফল হবেন বা এই প্রক্রিয়াতে ঢুকবেনই না, তারা রাষ্ট্রবিহীন হয়ে পড়বেন - সে সম্ভাবনাই প্রবল।
ট্রাইবুনালের প্রতি আস্থার অভাব
আসামের লেখিকা সঙ্গিতা বড়ুয়া পিশারডি বিবিসিকে বলেন, “যাদের নাম চূড়ান্ত তালিকাতে নেই তারা অত্যন্ত শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন যে তাদের এখন কী হবে। তার প্রধান কারণ ফরেনার্স ট্রাইবুনালের ভাবমূর্তি ভালো না, মানুষের আস্থা নেই।” “ফলে সেখানে গিয়ে আদৌ কাজ হবে কিনা তা নিয়ে বহু মানুষ সন্দিহান।” নাগরিকত্ব নির্ধারণে আসামে, এখন এ ধরনের ২০০টি বিশেষ আদালত বা ট্রাইবুনাল রয়েছে যেগুলোর অধিকাংশই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ২০১৪ সালে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর। অক্টোবরের মধ্যে এ ধরণের ট্রাইবুনালের সংখ্যা দাঁড়াবে ১০০০। এ সব আদালতের বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের বিস্তর অভিযোগ রয়েছ। তাদের কাজের মধ্যে কোনো ধারাবাহিকতাও নেই।
সবচেয়ে বড় কথা প্রমাণের সমস্ত দায় বর্তায় বিদেশী হিসাবে চিহ্নিত ব্যক্তির ওপর। লাখ লাখ দরিদ্র, নিরক্ষর মানুষের কাছে সবকিছুর লিখিত রেকর্ডও নেই।বন্যা কবলিত আসামের অনেক গরীব মানুষের পক্ষে রেকর্ডপত্র সংরক্ষণ করাও সম্ভব হয়নি।
সাংবাদিক রোহিনী মোহন আসামের একটি জেলায় এসব ট্রাইবুনালের ৫০০টিরও বেশি রায় বিশ্লেষণ করে দেখতে পান ৮২ শতাংশ অভিযুক্তকেই বিদেশী হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছে । ৭৮ শতাংশ রায় হয়েছে অভিযুক্তের বক্তব্য না শুনেই। যে হাজার খানেক মানুষকে আসামে ইতিমধ্যেই বিদেশী বলে চিহ্নিত করা হয়েছে, তাদের বিভিন্ন কারাগারের ভেতর ছটি আটক কেন্দ্রে আটকে রাখা হয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকার এখন একটি আলাদা আটক কেন্দ্র তৈরি করছে যেখানে ৩০০০ লোককে রাখা যাবে।
আরেক রোহিঙ্গা সঙ্কট :
রাজ্যের ক্ষমতাসীন দল বিজেপি বার বার জোর দিয়ে বলেছে অবৈধ মুসলিম অভিবাসীদের দেশ থেকে বের করে দেওয়া হবে। তবে প্রতিবেশী বাংলাদেশে বিভিন্ন সময় বলে দিয়েছে আসাম থেকে তারা একজনকেও গ্রহণ করবে না। অনেক পর্যবেক্ষক মনে করছেন, মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলিমদের মত ভারতের আসামে বিশাল সংখ্যক রাষ্ট্রহীন মানুষ তৈরি হতে চলেছে। তাদের জোর করে বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা করা হবে কিনা তা নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে এখনও কোনো ইঙ্গিত নেই। সরকারি শিক্ষা বা স্বাস্থ্য সেবা তারা পাবেনা কিনা তাও নিশ্চিত নয়। সবচেয়ে বড় কথা, জমিজমা রাখতে পারবেন কিনা সেটাও অস্পষ্ট । একটা ধারনা রয়েছে যে রাষ্ট্রবিহীন হয়ে পড়া মানুষগুলোকে হয়তো কাজ করার পারমিট দেওয়া হতে পারে এবং কিছু মৌলিক অধিকার দেওয়া হতে পারে। তবে ভোটের অধিকার থাকবে না-এটা নিশ্চিত।