গণবাণী ডট কম:
‘ঈশ্বর থাকেন ওই ভদ্র পল্লীতে, এখানে তাহাকে খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে না।’ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মা নদীর মাঝি কালজয়ী উপন্যাসের এ উক্তিতে প্রকৃতির প্রতিকূলতা, দারিদ্রের নির্মম যে বৈষম্য তুলে ধরা হয়েছে, গাজীপুরে চলমান বিদ্যুতের লোড শেডিং এর ক্ষেত্রেও তারই যেন বাস্তব চিত্র ফুটে ওঠেছে ।
গাজীপুর জেলার অন্তর্গত গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনটি সাবেক টঙ্গী পৌরসভা ও গাজীপুর পৌরসভা নিয়ে গঠিত হয়েছে। এই অঞ্চল মূলত শিল্প অধ্যুষিত অঞ্চল হিসেবে সারা দেশে সুপরিচিত। এ অঞ্চলে রয়েছে ছোট বড় প্রায় ৫ সহস্রাধিক শিল্প কল কারখানা ও অনেক বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান। কিন্তু বিদ্যুৎ সরবরাহার ক্ষেত্রে টঙ্গী অঞ্চলটি ডেসকু-১ এর অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় সেখানে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছে চাহিদার প্রায় কাছাকাছি। অপরদিকে গাজীপুর পল্লী বিদ্যুৎ ও অন্যান্য সমিতির অন্তর্গত গাজীপুর সিটির সাবেক গাজীপুর পৌরসভা অংশসহ জেলার অন্য অংশে চাহিদার তুলনায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছে অনেক কম। গাজীপুর মহানগরীর টঙ্গী ব্যতিত অন্য অংশের শিল্প কল কারখানায় উৎপাদন মারাত্বকভাবে ব্যহত হচ্ছে। উৎপাদন অব্যাহত রাখতে আগের তুলনায় ৪গুন বেশী ডিজেল জ্বালানী হিসাবে ব্যবহার বেড়েছে। একারণে উপাদন ব্যয় বাড়ছে।
গাজীপুর পল্লী বিদ্যুত সমিতি ১ সুত্রে জানা যায়, গাজীপুর জেলায় একাধিক প্রতিষ্ঠান থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়ে থাকে। এগুলো হলো ডেসকো-১; মহানগরীর টঙ্গী এলাকায়, ঢাকা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি- ১; গাজীপুরের চন্দ্রা, কালিয়াকৈর ও মৌচাক এলাকায়, গাজীপুর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-১; গাজীপুর মহানগরীর সাবেক গাজীপুর পৌরসভা ও কালীগঞ্জ উপজেলা এলাকায় এবং গাজীপুর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-২; গাজীপুরের কাপাসিয়া ও শ্রীপুরের আংশিক এলাকায় এবং ময়মনসিংহ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-২; গাজীপুরের মাওনা, শ্রীপুরের অবশিষ্ট অংশ এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করে থাকে।
গাজীপুর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-১ এর উপ মহা-ব্যবস্থাপক (কারিগরি) মোঃ জাহিদুল ইসলাম বলেন, গাজীপুরের উল্লেখিত জেলার সম্পূর্ণ এলাকায় বিদ্যুতের চাহিদা ১ হাজার ৫০ মেগাওয়াট। কিন্তু বর্তমানে জাতীয় গ্রীড থেকে সরবরাহ করা হচ্ছে ৭২৫ মেগাওয়াট। ফলে গাজীপুর জেলায় মোট লোডশেডিং হচ্ছে ৩২৫ মেগাওয়াট।
তিনি আরো বলেন, মজার ব্যাপার হল গাজীপুর জেলা সিটি কর্পোরেশন এলাকার টঙ্গী (সাবেক টঙ্গী পৌরসভা) এলাকায় ডেসকো-১ থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়ে থাকে। উক্ত এলাকার মোট চাহিদা ১৫০ মেগাওয়াট, সেখানে ১২৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়ে থাকে। ফলে টঙ্গী এলাকায় লোডশেডিং হচ্ছে মাত্র ২৫ মেগাওয়াট। যা বিদ্যুতের মোট চাহিদার মাত্র ১৪ শতাংশ কম। অপরদিকে, গাজীপুর মহানগরীর সাবেক গাজীপুর পৌরসভাসহ জেলার অন্যান্য এলাকায় বিদ্যুতের মোট চাহিদা ৯০০ মেগাওয়াট। সেখানে আমরা বিদ্যুৎ পাচ্ছি ৬০০ মেগাওয়াট। এখানে বিদ্যুতের লোডশেডিং হচ্ছে ৩০০ মেগাওয়াট। যা মোট চাহিদার প্রায় ৩৬ শতাংশ কম। ফলে একই জেলার টঙ্গীর তুলনায় অন্য অংশে লোড শেডিং বেশী করা হচ্ছে। এখানে আমরা সমন্বয় করতে পারছি না। একটি বৈষম্য থেকেই যাচ্ছে।
কয়েকজন শিল্পপতি অভিযোগ করেছেন, লোড শেডিং শিডিউল অনুযায়ী হচ্ছে না। কখনো নির্ধারিত সময়ের আগে বা পরে, আবার যেখানে দৈনিক ৩ বার লোড শেডিং হওয়ার কথা, সেখানে ৪/৫ বার লোড শেডিং হচ্ছে। জাতীয় গ্রেড থেকে গাজীপুরের টঙ্গী অংশ ব্যতীত অন্যান্য অংশে প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ সরবরাহ না পাওয়ায় লোডশেডিং এর মাত্রা এতটাই বেশি যে শিল্প উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে।
তাদের দাবী লোডশেডিং এর সময় শিল্প কারখানা চালু রাখতে গিয়ে শিল্প মালিকদেরকে পূর্বের যে কোনো সময়ের তুলনায় চার থেকে পাঁচ গুণ বেশি ডিজেল খরচ করতে হচ্ছে। এ কারণে শিল্পপতিরা মনে করছেন, সরকার জ্বালানি সাশ্রয়ের যে উদ্দেশ্যে লোডশেডিং সিডিউল চালু করেছে, কার্যত শিল্প প্রতিষ্ঠান চালু রাখতে গিয়ে সেই উদ্দেশ্য কোনোভাবেই পূরণ হচ্ছে না। কারণ বিদ্যুৎ সাশ্রয় করতে গিয়ে আমাদের জ্বালানি তেল ডিজেল পোড়াতে হচ্ছে, ফলে আমাদের ডিজেলের আমদানি বিগত যে কোন সময়ের তুলনায় কয়েক গুণ বেড়ে যেতে পারে।
গাজীপুর মহানগরীর তিন সড়ক এলাকার স্প্যারো অ্যাপারেলস লিমিটেড কারখানার জিএম (এডমিন) ফজলুল হক বলেন, আমাদের কারখানা এলাকায় লোডশেডিং সিডিউলের তুলনায় কখনো দেড় গুণ কখনো দ্বিগুণ হারে দেওয়া হচ্ছে। এখানে তিনবার সিডিউল লোড শেডিং দেওয়ার কথা, কিন্তু চারবার বা তার বেশী লোডশেডিং দেওয়া হচ্ছে এবং প্রতিবার লোড শেডিং দেওয়া হলে এক ঘন্টা লোডশেডিং থাকার কথা থাকলেও সেটি কখনো দেড় ঘন্টা বা তার বেশিও হয়ে যাচ্ছে।
তিনি আরো বলেন, আমার কারখানা সকাল আটটায় চালু হওয়ার পর দশটায় লোডশেডিং দেওয়া হয়। তখন আমার কারখানায় হাজার হাজার শ্রমিক কর্মরত থাকে এবং বিভিন্ন মেশিনারিজ চালু থাকে। এমন অবস্থায় কারখানার ভিতরে শ্রমিক রেখে আমি লোডশেডিং এ বসে থাকলে কোনভাবেই শ্রমিক নিয়ন্ত্রণ অথবা উৎপাদন চালু রাখা সম্ভব হবে না। এ কারণে আমাকে বাধ্য হয়ে ডিজেল দিয়ে জেনারেটর এবং অন্যান্য যন্ত্রপাতি চালু করে বিকল্প উপায়েয়ে উৎপাদন চালু রাখার জন্য আমার সার্বক্ষণিক বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা জরুরী। তিনি বলেন, এসব কারণে আমার দৈনিক প্রায় ৭ লক্ষ টাকা ডিজেল কিনতে হচ্ছে। যা অন্যান্য সময়ের তুলনায় প্রায় তিন থেকে চার গুণ বেশি। তিনি আরো বলেন, একই সময়ে আমাদের গ্যাসের চাপও অনেক কম রয়েছে। যেখানে ১৫ সিএফটি থাকার কথা সেখানে আমরা দুই/তিন সিএফটি গ্যাস পাচ্ছি। ফলে আমাদের ইটিপিসহ অন্যান্য প্লান্ট চালু রাখার জন্য ডিজেলের উপরেই আবার নির্ভর করতে হচ্ছে। এভাবে আমাদের শিল্প উৎপাদন চালু রাখা কোনভাবেই সম্ভব নয়।
গাজীপুরের সাদমা গ্রুপের মালিক ও বিজিএমইএ এর সহ-সভাপতি নাসির উদ্দিন বলেন, সিডিউল অনুযায়ী যদি লোডশেডিং সীমাবদ্ধ রাখতে পারে তাহলে কোন সমস্যা ছিল না। কিন্তু দেখা যাচ্ছে যে সিডিউল অনুযায়ী লোডশেডিং নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। আগে পরে হচ্ছে এবং একাধিকবার হচ্ছে। কোথাও বেশি পরিমাণে হচ্ছে ফলে আমরা পূর্ব প্রস্তুতি নিয়ে মোকাবেলা করতে পারছি না। এছাড়া লোডশেডিং সময়ে আমাদের ছোট ছোট জেনারেটর দিয়ে ডিজেল ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে আমাদের উৎপাদন সচল রাখতে হচ্ছে। এতে বিদ্যুৎ সাশ্রয় হলেও ডিজেলের খরচ বেড়ে যাচ্ছে। তাই আমাদের এ বিষয়টি নিয়েও ভাবতে হবে।
বিদ্যুৎ সংশ্লিষ্ট নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক প্রকৌশলী বলেন সরকার শিল্প ইন্ডাস্ট্রিতে বিকল্প উপায়ে কেন্দ্রীয়ভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহ করলে ডিজেলের উপরে বাড়তি এই চাপ কমতে পারে। কেন্দ্রীয়ভাবে ডিজেল দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে সেই বিদ্যুৎ শিল্প কারখানা সরবরাহ করা হলে বর্তমানে আলাদা আলাদা ভাবে শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোতে যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ডিজেলের খরচ হচ্ছে তা অনেক কমে যাবে।
গাজীপুর মহানগরীর জয়দেবপুর বাজারের ব্যবসায়ী অসিত সাহা বলেন, আমাদের এখানে সিডিউল অনুযায়ী লোডশেডিং দেওয়া হচ্ছে না। কখনো আগে কখনো পরে আবার কখনো নির্ধারিত সময়ের অতিরিক্ত এবং ৪/৫ বার করে লোডশেডিং দেওয়া হচ্ছে। আমাদের দোকান এবং বাসায় নানা রকম অসুবিধা তৈরি হচ্ছে। তিনি লোডশেডিং সিডিউল অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার দাবি জানান।
গাজীপুর মহানগরীর হাবিবুল্লা সরনীর মিতু সেতু বুটিকের মালিক নুরজাহানা আক্তার মিলি বলেন, আমার দোকান এবং বাসায়ও দৈনিক চার-পাঁচবার করে লোডশেডিং দেওয়া হচ্ছে। বিশেষ করে সন্ধ্যার পরে লোডশেডিং এর কারণে আমার মেয়েদের পড়ালেখার খুবই অসুবিধা হচ্ছে। এখানেও সিডিউলের বাইরে অতিরিক্ত লোডশেডিং করা হচ্ছে।
এসব বিষয়ে গাজীপুর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-১ এর উপ মহা-ব্যবস্থাপক (কারিগরি) মোঃ জাহিদুল ইসলাম বলেন,তিনি আরো বলেন, আমাদের কড্ডা বিদ্যুৎ উপকেন্দ্রে ৩৪২ মেগাওয়াট চাহিদা রয়েছে, কিন্তু এই উপকেন্দ্রে আমরা বিদ্যুৎ সরবরাহ পাই ২২০ মেগাওয়াট, কখনো ২০০ মেগাওয়াট। আবার জয়দেবপুর উপকেন্দ্রে আমাদের চাহিদা ১৯৫ মেগাওয়াট কিন্তু এখানে অনেক সময় বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয় ৬০ মেগাওয়াট, আবার কখনো ৪০ মেগাওয়াট। ফলে আমরা জাতীয় গ্রীড থেকে কি পরিমাণ বিদ্যুৎ পেয়ে থাকি বা কি পরিমাণ বিদ্যুৎ আমরা ভবিষ্যতে পাব তার উপরে ভিত্তি করে আমরা একটি অঞ্চল ভিত্তিক লোডশেডিং এর শিডিউল তৈরি করেছি। অনেক সময় দেখা যায়, আমরা শিডিউল অনুযায়ী লোডশেডিং শেষ করে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু করলাম, ঠিক তখনই জাতীয় গ্রেড থেকে আমাদের এখানে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দিল। তখন অনিবার্যভাবে আবার লোডশেডিং শুরু হয়। এই ক্ষেত্রে আমাদের আর কিছু করার থাকে না। পুনরায় জাতীয় গ্রীড থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু হলে আমরাও লোডশেডিং শেষ করতে পারি।