গণবাণী ডট কম:
আওয়ামীলীগ দলীয় সংসদ সদস্য সাবের হোসেন চৌধুরীর উত্থাপিত একটি বেসরকারি সিদ্ধান্ত প্রস্তাব নিয়ে বৃহস্পতিবার সংসদ কিছুক্ষণের জন্য উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। বৃহস্পতিবার বেসরকারি দিবসে সাবের চৌধুরীর তামাকজাত দ্রব্যের উপর প্রচলিত অ্যাড–ভেলারাম (স্তরভিত্তিক মূল্যের শতকরা হার) পদ্ধতির পরিবর্তে সুনির্দিষ্ট করারোপ করার দাবি জানিয়ে বেসরকারি সিদ্ধান্ত প্রস্তাব সংসদে উপস্থাপন করেন। তার প্রস্তাব ছিল ‘সংসদের অভিমত এই যে,সকল প্রকার তামাকজাত দ্রব্যের ওপর প্রচলিত অ্যাড-ভেলোরাম পদ্ধতির পরিবর্তে সুনির্দিষ্ট করারোপ (স্পেসিফিক ট্যাক্স)করা হোক।’
তবে এই প্রস্তাবটি প্রত্যাহার বা গ্রহণের বিষয়টি নিষ্পত্তি করতে স্পিকার ড.শিরীন শারমিন চৌধুরী কণ্ঠভোটে দিলে বেশিরভাগ সংসদ সদস্য তালগোল পাকিয়ে ফেলেন। প্রথমে বুঝতে না পেরে তারা ‘হ্যাঁ’এর স্থলে ‘না’ভোট দেন;অর্থাৎ তারা প্রস্তাবটি গ্রহণের পক্ষে সম্মতি দিয়ে দেন। পরে সংসদ সদস্যদের মনোযোগ আকর্ষণ করে স্পিকার পুনরায় ভোটে দিলে সাবেরের প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যাত হয়। এর আগে সংশোধনী দিয়ে সাবের চৌধুরীর প্রস্তাবে সমর্থন জানান আরো ৯ জন সংসদ সদস্য। কণ্ঠভোটে সংসদ সদস্যরা তালগোল পাকিয়ে ফেলার পর তা নিষ্পত্তিতে স্পিকারের সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করেন প্রস্তাব উত্থাপনকারী সাবের। এরপর সাবেরের পক্ষ নিয়ে কথা বলেন ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন। ক্ষমতাসীন দলের কোন সদস্য স্পিকারের সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করার ঘটনা বাংলাদেশের সংসদে খুবই বিরল ঘটনা।
এর আগে সাবের তার প্রস্তাবের পক্ষে বলেন, বাংলাদেশে তামাক ব্যবহারজনিত রোগে প্রতিবছর এক লাখ ৬১ হাজার মানুষ অকালে মারা যায়। প্রায় ১৫ লাখ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়। প্রায় ৬১ হাজার শিশু পরোক্ষ ধূমপানের কারণে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়। ২০১৭–২০১৮ অর্থবছরে তামাক ব্যবহারের অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ ৩০ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা, যা একই সময়ে তামাকখাত থেকে অর্জিত রাজস্ব আয়ের চেয়ে বেশি। বর্তমানে বাংলাদেশে তামাকের যে কর–কাঠামো তা অত্যন্ত জটিল, পুরোনো ও অকার্যকর বলে মন্তব্য করে সাবের বলেন, বিশ্বের মাত্র ছয়টি দেশে এভাবে করারোপ করা হয়। অন্যদিকে ফিলিপিন্স, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, অস্ট্রেলিয়াসহ বেশিরভাগ দেশে সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি চালু আছে। এটি করা হলে রাজস্ব আয় বাড়বে।
প্রস্তাবের বিরোধিতা করে জবাবে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, বর্তমান আইনে তামাকপণ্যে সুনির্দিষ্ট করারোপের সুযোগ নেই। চলমান বাজেটে স্তরভিত্তিক শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে এবং গ্রাহকের ক্রয় ক্ষমতা বিবেচনায় এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তবে ক্রমান্বয়ে সুনির্দিষ্ট করারোপ পদ্ধতি চালু করার বিষয়টি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে। ভবিষ্যতে হয়ত একদিন এটি হবে।
সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীর বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে সাধারণত প্রস্তাবকারী সদস্য সিদ্ধান্ত প্রস্তাব প্রত্যাহার করে নেন। কিন্তু সাবের চৌধুরী তার প্রস্তাব প্রত্যাহার করতে রাজি হননি। তখন নিয়ম অনুযায়ী প্রস্তাবটি কণ্ঠভোটে দেন স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী।
সংসদে কোনো বিষয় ভোটে দেওয়ার পর সরকারি দলের প্রধান হুইপ বা অন্য কোনো হুইপ হাত তুলে তার পক্ষে বা বিপক্ষে অবস্থান জানান। তখন সরকারি দলের বাকি সদস্যদের তাকে অনুসরণ করতে দেখা যায়।
স্পিকার বিষয়টি ভোটে দেওয়ার সময় বলেন,“সাবের হোসেন চৌধুরীর এই প্রস্তাবটি প্রত্যাহার করা হোক, যারা এর পক্ষে আছেন তারা ‘হ্যাঁ’ বলুন।”
খুব কম সংখ্যক সদস্য ‘হ্যাঁ’ বলেন।
স্পিকার এরপর বলেন,“যারা এর বিপক্ষে আছেন তারা ‘না’ বলুন।”
বেশিরভাগ সদস্য ‘না’ বলেন। অর্থাৎ বেশিরভাগ সদস্য সাবের চৌধুরীর বেসরকারি প্রস্তাবটির পক্ষে ভোট দিয়ে দেন। এ সময় স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীকে হাসতে দেখা যায়।
পরে তিনি আবার সব সদস্যের ‘মনোযোগ আকর্ষণ’ করে প্রস্তাবটি আবার পড়ে শোনান এবং দ্বিতীয় দফা ভোট দেন। এই দফায় ভোটে ‘হ্যাঁ’ ভোট জয়ী হয়। অর্থাৎ সাবের চৌধুরীর প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যাত হয়।
এরপর স্পিকার অন্য বিষয়ে চলে যেতে চাইলে সাবের চৌধুরী কথা বলার সুযোগ চান। কিছুক্ষণ পর কথা বলার সুযোগ পেয়ে সাবের চৌধুরী দাবি করেন, প্রথমবার কণ্ঠভোটেই তার প্রস্তাব পাস হয়ে গেছে। প্রথম দফা কণ্ঠভোটেই বিষয়টি নিষ্পত্তি হয়ে যায়। পরবর্তীতে আবার স্পিকার ভোটে দিলেন। একটা বিষয়ে দুবার ভোটের কোনো নজির আছে বলে মনে হয় না। অবশ্যই আমি হতাশ।
তিনি বলেন, “একই বিষয়ে দুইবার ভোট হতে পারে কি না? আমরা যখন বেসরকারি সদস্য হিসেবে কোনো বিষয় সংসদে উত্থাপন করি, একজন মেম্বার হিসেবে করি। এটা আমাদের অধিকার। এখানে সরকারের হুইপিংয়ের কোনো বিষয় নেই। পরবর্তীতে যেভাবে হাত দেখিয়ে ভোট পাল্টাবে, এই নজির সংসদে রাখা উচিৎ নয়। আমরা চাই না এই সংসদে এমন কোনো নজির স্থাপন হোক, যেটা নিয়ে ভবিষ্যতে আলোচনায় আসবে।
আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য সাবের স্পিকারের উদ্দেশে বলেন, “আপনার রুলিং সম্মান করি। আমার কথাগুলো কার্যবিবরণীতে থাকা উচিৎ। এতই যদি কনফিউশন থাকত, আমি তখন দাঁড়িয়েছিলাম কেন? এটা নিয়ে যদি কোনো কনফিউশন থাকত, তাহলে আমরা একটা ডিভিশন দেই। এই একটা ভোটে তো সরকারের পতন হয়ে যাবে না।
“এটাতো সরকারের বিপক্ষে ভোট না। এটা জনস্বার্থের পক্ষে একটা ভোট। সে উদারতা আমাদের মননীয় মন্ত্রীদের কাছ থেকে প্রত্যাশা করি। এবং জাতীয় স্বার্থেই তারা এ ধরনের আচরণ করবেন বলে আশা করি।”
স্পিকারের উদ্দেশে সাবের আরও বলেন, “প্রসিডিংস দেখেন, সিদ্ধান্ত স্থগিত রাখেন। যদি প্রমাণ হয় প্রথম ভোটটি স্পষ্ট ছিল, সে হিসাবে আমার সিদ্ধান্ত প্রস্তাবটি গ্রহণ করবেন। সেটাই সংসদের অভিমত হিসেবে গণ্য হবে।”
এ পর্যায়ে রাশেদ খান মেনন স্পিকারের উদ্দেশে বলেন, “আপনি অভিভাবক। বেসরকারি সদস্য দিবস সদস্যদের বিশেষ অধিকার। যেগুলো জরুরি মনে করে, নিয়ে আসে। সংসদে নজির আছে বেসরকারি সিদ্ধান্ত প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রশ্ন নিয়ে প্রস্তাব এসেছিল, গ্রহণ হয়েছিল।” মেনন আরো বলেন, “আমি আমার কক্ষে ছিলাম। টেলিভিশনে দেখছিলাম, আপনার একজন কর্মকর্তা কী যেন বললেন, তারপর আবার ভোটে দিলেন। মাননীয় স্পিকার আপনি বলতে পারতেন, আপনি ডিভিশনে যান। তখন হয়ত তিনি হেরে যেতেন। এই যে পদ্ধতিগত প্রশ্ন এখানে আসল এটা খুব খারাপ দৃষ্টান্ত হল। সিদ্ধান্ত স্থগিত রেখে প্রসিডিংস যাচাই করুণ,তারপর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করুন।”
পরে জবাবে স্পিকার শিরীন শারমিন বলেন, “প্রথম যে বিষয়টি হয়েছে প্রত্যাহারের বিষয়ে মন্ত্রী অনুরোধ করেছেন। নিয়ম অনুযায়ী ভোটে দেওয়া হয়েছে। যেভাবে ভোটটা হয়েছে, আমি এই চেয়ারে বসে একটু কনফিউজড ছিলাম। সংসদের অভিমত কী, সে বিষয়টি আমার কাছে স্পষ্ট ছিল না। যে কারণে আমি পুনরায় ভোটে দিই। তিনি বলেন,“আমি কিন্তু সিদ্ধান্ত নিইনি। ভোটের পরে কোনো সিদ্ধান্তের কথা না বলে আমি আবার ভোটে দিই। যাদের এই বিষয়ে অধিকার, তাদের সামনেই সেটি উপস্থাপন করি। তখন একটা ভিন্ন মত এসেছে।”“এখন যদি আমার মনে হয় আমি সঠিক ছিলাম। যদি সদস্যের পক্ষে ভোট হত, দ্বিতীয়বারও একই ফল আসত । যেটা আপনি দাবি করছেন। কিন্তু দ্বিতীয় ভোটে সেটা হয়নি। এখানে হুইপিংয়ের ইস্যু নেই, কোনো হুইপের সাথে কথাও বলিনি। সংসদ সদস্যরা যেটা যথাযথ মনে করেছেন, তাদের সামনে উপস্থাপন করা হয়েছে।”স্পিকার বলেন, “এখানে কোনো পক্ষপাতিত্বের কোনো বিষয় নেই। বেসরকারি সিদ্ধান্ত উত্থাপন করেছেন এটা আপনার অধিকার। রাশেদ খান মেনন যে কথা বলেছেন সেখানে কিছু বক্তব্য অপ্রাসঙ্গিক মনে হয়েছে। জাতীয় স্বার্থ বিঘ্নিত হোক এধরনের কোনো কিছুই এই হাউজে করা হয় না। কার্যপ্রণালী বিধি অনুসরণ ছাড়া এখানে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় না। এর আগে অনেক নজির আছে স্পিকারের মনে হয়েছে, সিদ্ধান্ত স্পষ্ট নয়, তখন পুনরায় ভোটের নজির আছে।” স্পিকারের বক্তব্যের সময় দুই দফা সরকারি দলের সদস্যরা টেবিল চাপড়ে স্পিকারকে সমর্থন জানান।
প্রসঙ্গত : পঞ্চম সংসদে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন বিরোধী দলের সদস্যদের ভোটে কোস্টগার্ড গঠন সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত প্রস্তাব গৃহীত হয়েছিল। ওই দিন সরকারি দল বিএনপির বেশির ভাগ সংসদে অনুপস্থিত ছিল। ২০১২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি তৎকালীণ আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলামের অনুরোধ উপেক্ষা করে সংসদে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বাধাদানকারীদের আইনের আওতায় আনার বিষয় সংক্রান্ত বেসরকারি সিদ্ধান্ত প্রস্তাব গৃহীত হয়েছিল।