গণবাণী ডট কম:
বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্প বিষয়ে জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল কর্মপরিকল্পনার অংশ হিসেবে গণশুনানি ও অংশীজন সভায় অংশ নিয়ে প্রকল্পের দীর্ঘসূত্রিতা, অব্যবস্থাপনা, নকশার ছুটিসহ নানা কারণে তোপের মুখে পড়েন কর্মকর্তারা। সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের (উন্নয়ন) অতিরিক্ত সচিব ও প্রকল্প সমন্বয়ক এ, কে, এম শামীম আক্তার।
সভায় অংশ নিয়ে বক্তাগণ বিআরটি প্রকল্পের নকশার ত্রুটি, দীর্ঘসূত্রিতা, মানুষের ভোগান্তী, ফুটপাথ না থাকা, ইউটার্ণ না থাকা, মানুষের মহাসড়ক পারাপারের ব্যবস্থা না থাকাসহ এর নানা সীমাবদ্ধতার কথা তুলে ধরেন। বিভিন্ন জনের কাছ থেকে একের পর এক প্রশ্ন ও অভিযোগ, প্রকল্পের বিভিন্ন ত্রুটি তুলে ধরে বক্তব্য আসতে থাকলে, এক পর্যায়ে এক কর্মকর্তা বলতে বাধ্য হন, আসলে গাজীপুরের মত এরকম একটি গুরুত্বপূর্ণ গেটওয়ে তে বিআরটির মত প্রকল্প নেওয়াই উচিত হয়নি।
বুধবার বিকালে সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগের বাস র্যাপিড ট্রানজিট কোম্পানী এই গণশুনানি ও অংশীজন সভার আয়োজন করে। গাজীপুর জেলা প্রশাসকের ভাওয়াল সম্মেলন কক্ষে সভাটি অনুষ্ঠিত হয়ে। এতে বিশেষ অতিথি ছিলেন গাজীপুর জেলা প্রশাসক আবুল ফাতে মোহাম্মদ সফিকুল ইসলাম, গাজীপুরের সাবেক মেয়র জাহাঙ্গগীর আলম। সভায় সভাপতিত্ব করেন বিআরটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. মো. মনিরুজ্জামান (অতিরিক্ত সচিব, পিআরএল)।
অনুষ্ঠানের শুরুতে বিআরটি প্রকল্পের এয়ারপোর্ট-গাজীপুর অংশ নিয়ে একটি প্রেজেন্টেশন প্রদান করা হয়। বিভিন্ন অংশীজন, সুধীবৃন্দ, প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় সদস্যবৃন্দ অংশগ্রহণ করেন। সভা শেষে একটি প্রেস ব্রিফিং অনুষ্ঠিত হয়।
গণশুনানিতে জানানো হয়, গাজীপুর শহরের শিববাড়ি থেকে ঢাকা বিমান বন্দর পর্যন্ত ২০ দশমিক ৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ পথ বাসে যেতে সময় লাগবে ৪৪ মিনিট। কোম্পানির নিজস্ব ১৩৭টি নতুন ডিজেল চালিত এসি বাস চলাচল করবে। প্রকল্পের শিববাড়ি ও বিমানবন্দরে দুটি বাস টার্মিনাল, ৮ টি ফ্লাইওভার, ২৫টি বাস স্টপেজ, ১৫টি ফুট ওভারব্রিজ, ফুটপাত ৩২ কিলোমিটার, উভয় পাশের ড্রেন ৫৫ কিলোমিটার এবং মাটি থেকে নিয়ম অনুযায়ী উচ্চতা থাকবে ৮ দশমিক ৫ মিটার। বাস চলাচলের সময় কোথাও জ্যাম থাকবে না এবং যথারীতি ৪৪ মিনিটে গন্তব্যে পৌছার নিশ্চয়তা থাকবে।
দেশের উত্তরাঞ্চলের সাথে যোগাযোগ ব্যবস্থাকে সহজ করার লক্ষ্যে বাস্তবায়নাধীন ট্রানজিট বা বিআরটি প্রকল্পটি ২০১২ সালে শুরু হয়। শুরুর প্রায় এক যুগ পর গণশুনানিতে অংশ নিয়ে তোপের মুখে পড়েছেন এর কর্মকর্তারা।
আলোচনার শুরুতে বক্তব্য রাখেন, গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র ও সিটি কর্পোরেশনের মেয়রের প্রধান উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম। তিনি প্রকল্পের সুনির্দিষ্ট ১৭টি ত্রুটির বিষয় উল্লেখ করে বক্তব্য রাখেন। এসময় তিনি বলেন, যারা এরকম ত্রুটিপূর্ণ একটি নকশা প্রণয়ন করেছে, সরকারের হাজার কোটি টাকা নষ্ট করেছে, লক্ষ লক্ষ মানুষের দুর্ভোগ সৃষ্টি করেছে, তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। তিনি বলেন, প্রকল্পের শুরুতে যারা এই প্রকল্পের সাথে যুক্ত ছিলেন, আজকের এই সভার কেউ তখন ছিলেন না। ফলে এখানে আমরা যা আলোচনা করব তা স্থানীয় জনগণের স্বার্থে আলোচনা করব। কেউ এগুলো ব্যক্তিগতভাবে নিবেন না। তিনি অভিযোগ করেন, প্রকল্পের শুরুতে কথা ছিল মহাসড়কের দুই পাশের হকারদের জন্য দশটি হকার্স মার্কেট নির্মাণ করা হবে, দুই পাশে ড্রেনের পানি অপসারণের জন্য মহাসড়কের দুই পাশের পাঁচটি খাল খনন করা হবে। কিন্তু এর কিছুই করা হয়নি। তিনি বলেন, এই প্রকল্পের ভোগড়া এলাকার ফ্লাইওভারের উচ্চতা কম থাকায়, পণ্যবাহি যানবাহন চলাচলে অসুবিধা হবে। ড্রেন অত্যন্ত সরু হওয়ায় মহাসড়কের পানি অপসারিত হবে না। বিআরটি স্টেশনে আসা যাওয়ার জন্য ৭২ ফুট উচু সিড়ি নির্মাণ করা হয়েছে, ফলে বয়স্ক মানুষ, মহিলা ও শিশুরা এই সিড়ি অতিক্রম করে যাতায়াতে দুর্ভোগে পড়বেন। সওজের আগে ১০০ ফুট চওড়া মহাসড়ক ছিল। অথচ অনেক স্থানে বিআরটি সড়কের বাইরে দেশের উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের জেলার যানবাহন চলাচলের মহাসড়ক অত্যন্ত শুরু হয়ে পড়েছে।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের নির্বাহী প্রকৌশলী হাসান আলী অভিযোগ করেন, প্রকল্পের জন্য তাদের প্রতিষ্ঠানের সীমানা প্রাচীর ভাঙতে হয়েছে। কথা ছিল উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিয়ে এই সীমানা প্রাচীর বিআরটি কর্তৃপক্ষ পুনরায় নির্মাণ করে দিবে। কিন্তু তারা তা না করায় আন্তর্জাতিক মানের এ গবেষণা প্রতিষ্ঠানের গবেষণা কার্যক্রম ব্যাঘাত হচ্ছে।
গাজীপুর মহানগরীর চন্দনা এলাকার বাসিন্দা মজিবুর রহমান আলোচনায় অংশ নিয়ে বলেন, এত বড় প্রকল্পটি শুধু ঢাকা ময়মনসিংহ মহাসড়ক কেন্দ্রিক করা হয়েছে। এই প্রকল্পের সাথে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ককে যুক্ত করা হয়নি।
গাজীপুর প্রেসক্লাবের সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান টিটু বলেন, এই প্রকল্পটির চান্দনা চৌরাস্তা থেকে শিববাড়ি মোর পর্যন্ত ৭ কিলোমিটার সড়কের কোথাও এক ইঞ্চিও ফুটপাত রাখা হয়নি। এমনকি এই দীর্ঘ পথের কোথাও কোনো ইউটার্ণ নেই।
আজকের পত্রিকার গাজীপুর প্রতিনিধি মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান বলেন, দীর্ঘ মহাসড়কে বিআরটি লেনের বাইরে অনেক জায়গায় বিআরটি স্টেশনে যাত্রী আসা যাওয়ার জন্য ফুটপাত বন্ধ করে সিঁড়ি নির্মাণ করা হয়েছে। যাত্রী পারাপারের কোন ব্যবস্থা রাখা হয়নি। এছাড়া গাজীপুরের লক্ষ লক্ষ তৈরির পোশাক শ্রমিক পারাপারের জন্য কোন ফুটওভার ব্রিজ অথবা একপাশের যানবাহন অন্যপাশে যাওয়ার জন্য কোন ইউটার্ন রাখা হয়নি। যে ড্রেন নির্মাণ করা হয়েছে, সেটি অপ্রশস্ত হওয়ায় এবং এসব ড্রেনের পানি নির্দিষ্ট কোন গন্তব্য নির্ধারণ না করায় এর কার্যকারিতা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।
একাত্তর টিভির গাজীপুর প্রতিনিধি ইকবাল সরকার বলেন, এই প্রকল্পে সড়ক বাতি কিভাবে দেওয়া হবে, এসব আমরা কিছুই জানিনা।
কয়েকজন গণমাধ্যম কর্মী অভিযোগ করেন বিভিন্ন সময়ে বিআরটি প্রকল্পের কর্মকর্তাদের ফোন করলেও তারা সাড়া দেন না।
এসব বিষয় বিআরটি প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক ইলিয়াস শাহ উত্তর দিতে শুরু করলে তার বক্তব্য সন্তোষজনক না হওয়ায় অংশগ্রহণকারীরা কথা বলতে থাকেন। পরে মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব তাকে থামিয়ে দেন। তিনি বলেন, আপনি স্বীকার করে নেন যে, এখানে বিভিন্ন ত্রুটি বিচ্যুতি রয়েছে। যা ভবিষ্যতে আমরা সমাধান করব।
এক পর্যায়ে জেলা প্রশাসক প্রস্তাব করেন, যেহেতু অনেক সমস্যা এখানে আলোচনা হয়েছে। এসব সমস্যা চিহ্নিত করে একটি প্রস্তাবনা উপস্থাপন করার জন্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জেলা প্রশাসন এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে একটি কমিটি করা যেতে পারে। এই কমিটি সব মহলের সাথে আলোচনা করে একটি প্রস্তাবনা উপস্থাপন করবে এবং সেই অনুযায়ী পরবর্তীতে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
পরে প্রকল্পের নবনিযুক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. মো. মনিরুজ্জামান বলেন, আজকে আমরা আপনাদের কাছ থেকে অনেক মূল্যবান বক্তব্য শুনলাম। প্রকল্পের অনেক ত্রুটি সীমাবদ্ধতা আমাদের চোখে ধরা পড়েছে। আমরা এগুলো সমাধান করব। আমরা ভবিষ্যতে ফুটপাত এবং রাস্তা সম্প্রসারণের জন্য প্রয়োজনে অতিরিক্ত জমি অধিগ্রহণ করে আজকের চিহ্নিত সমস্যা গুলোর সমাধান করব।
পরে প্রকল্প পরিচালক ইলিয়াস শাহ বলেন, যানবাহন চলাচলের সুবিধার জন্য প্রকল্প এলাকায় সাতটি ইউটার্নের ব্যবস্থা রাখা হবে।
এ পর্যায়ে প্রকল্প সমন্বয়ক এ, কে, এম শামীম আক্তার বলেন, বিআরটি প্রকল্প এখন শেষ পর্যায়ে রয়েছে। আজকে যে সমস্যাগুলো আলোচনা হয়েছে, এগুলো আমরা চিহ্নিত করে ভবিষ্যতে অন্য কোন প্রকল্প গ্রহণ করে এসব সমস্যার সমাধান করব। এসময় তিনি প্রকল্প বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রিতা সত্ত্বেও ধৈর্য সহকারে এ কাজে সহায়তা করার জন্য তিনি গাজীপুরবাসীকে ধন্যবাদ জানান।
উল্লেখ্য, রাজধানীর সাথে দেশের ঐ অঞ্চলের যোগাযোগ সহজ করতে ২০১২ সাল হাতে নেয়া হয় রাজধানীর বিমান বন্দর থেকে গাজীপুর ২০.৫ কিলোমিটার সড়ক ও ফ্লাইওভার নির্মাণের জন্য বিআরটি প্রকল্প। প্রকল্পের শুরুতে ব্যয় ধরা হয় ২ হাজার ৩৯ কোটি ৮৪ লাখ ৮৯ হাজার টাকা। কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে। কয়েক দফা সময় বাড়িয়ে ২০২২ সালের জুন নির্ধারণ করা হয়। আর সময় বৃদ্ধির সাথে পাল্লা দিয়ে ব্যয়ও বেড়েছে। সবশেষ ব্যয় ধরা হয়েছে ৪ হাজার ২৬৮ কোটি ৩২ লাখ টাকা। কিন্তু প্রকল্প চালু হওয়ার পর এক যুগ পেরিয়ে গেল। তারপরেও নির্ধারিত সময়ে শেষ হয়নি প্রকল্পের কাজ। এখন আশা করা হচ্ছে ডিসেম্বরে চালু হতে পারে বিআরটি।