কাপাসিয়া (গাজীপুর) সংবাদদাতা
গাজীপুর জেলার কাপাসিয়া উপজেলার সিংহশ্রী ইউনিয়নের প্রত্যন্ত পলøী অঞ্চলে কৃষি নির্ভর এলাকা কপালেশ্বর গ্রামে প্রোটিন হাউজ ও টোক ইউনিয়নের কেন্দুয়াব গ্রামে ডায়মন্ড নামে দুটি মুরগী পালনের খামারের সৃষ্ট বর্জ্য ও নিষ্কাশিত দুষিত পানিতে বিনষ্ট হচ্ছে এলাকার খাল-বিল, নদী-নালার পানি, মাছ ও কৃষি জমি। উৎকট দুর্গন্ধে অতিষ্ট স্কুল-কলেজ মাদ্রাসার ছাত্র-ছাত্রীসহ এলাকাবাসী। মুরগির বর্জ্য ও বিষাক্ত পানি দ্বারা আশে পাশের ১৫ গ্রামের পরিবেশ ও ফসলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে।
জানা যায়, ঢাকার বাড্ডা এলাকার কায়সার আহমেদ কাপাসিয়া উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১৬ কিঃ মিঃ দূরে ২০০৯ সালে কপালেশ^র গ্রামে অধিকাংশ কৃষি জমি নিয়ে প্রায় ৭০ বিঘা জমিতে প্রায় ৩ লাখ এবং ২০১৪ সালে টোক ইউনিয়নের কেন্দুয়াব গ্রামে প্রায় ১৩০ বিঘা জমিতে প্রায় ৮ লাখ লেয়ার মুরগী পালনের জন্য ডায়মন্ড নামে আরো একটি খামার প্রতিষ্ঠা করেন। দুটি প্রতিষ্ঠানের প্রায় ১১ লাখ মুরগী পালন করা হয়, কিন্তু মুরগীর উৎপাদিত বর্জ্য (লিটার) ব্যবস্থাপনার কোন আধুনিক প্রযুক্তি বা বর্জ্য শোধনাগার ব্যবহার করা হচ্ছে না।
স্থানীয় লোকজনের অভিযোগ, আশপাশের জমিতে রাতের আঁধারে বর্জ্য এবং নিষ্কাশিত পানি ফেলায় জমিগুলোতে এখন আর কোন ধরনের ফসল উৎপাদন হচ্ছে না। আর এসব দ‚ষিত বর্জ্য ও নিষ্কাশিত পানির দুর্গন্ধে অনেকেই এখন গ্রাম ছাড়া। মুরগীর বর্জ্যের দূর্গন্ধ ও মশা-মাছির কারনে আশ পাশে কাপালেশ^র, নামিলা, নরদা, সোহাগপুর, বড়িবাড়ী, ভিটিপাড়া, ঝাওয়াদী, লোহাদী, বীরউজুলী, কেন্দুয়াব, ছাটারবর, বড়চালা, দীঘিরপাড়, উলুসারা, টোক নগরসহ কমপক্ষে ১৫টি গ্রামের মানুষ অতিষ্ট হয়ে পড়েছে। এ ছাড়াও কপালেশ^র উচ্চ বিদ্যালয়, কপালেশ^র সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, কপালেশ^র কিন্ডারগার্টেন, নামিলা আফতাব উদ্দিন মেমোরিয়াল স্কুল, নামিলা ফাজিল মাদ্রাসা, নামিলা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, নরদা আসর উদ্দিন সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, কেন্দুয়াব সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, বীর উজুলী উচ্চ বিদ্যালয়, বীরউজুলী সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, ছাটারবর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, উলুসারা কাদির ভূইয়া উচ্চ বিদ্যালয়, কেন্দুয়াব সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, উলুসারা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, বড়চালা আমির উদ্দিন মাদ্রাসাসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীরা খামারের জেনারেটরের বিকট শব্দে ও দূর্গন্ধে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যাওয়া আসা ও ক্লাসে বসে লেখা পড়া করতে পারছে না। অনেক সময় মুরগীর বৃষ্টাও মাটি রাতে আধাঁরে পাশের জমিতে ছেড়ে দেয় ফলে জমির মালিক কম মূল্যে জমি বিক্রয় করতে বাধ্য হয়। পোল্ট্রি খামারের নিষ্কাশিত পানি ও বর্জ্য প্রতিনিয়ত মাটিতে ফেললে মাটির মধ্যে মিথেন গ্যাসের সৃষ্টি হয়। মিথেন গ্যাস মাটির শিকড় নষ্ট করে ফেলে। আর এ কারনেই ওইসব ফসলি জমিতে কোন ধরনের ফসল ফলানো সম্ভব হয় না। প্রতিষ্ঠান দুটির জেনারেটরের বিকট শব্দে লেখাপড়া বন্ধের উপক্রম হচ্ছে আশ পাশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীদের। প্রতিষ্ঠানের আশপাশের জমিতে রাতের আঁধারে বর্জ্য এবং নিষ্কাশিত পানি ফেলায় জমি গুলোতে এখন আর কোন ধরনের ফসল উৎপাদন হচ্ছে না। অপরদিকে পাশের আমুরী নদী বিলে এসব বর্জ্য ও নিষ্কাশিত পানি ফেলে নদী ও বিল এবং আশপাশের পুকুরের মাছ মরে গেছে। আশ পাশের খোলা জায়গায় হাজার হাজার ব¯Íা মুরগীর বর্জ্য ফেলে রাখাতে দূর্গন্ধে রা¯Íা দিয়ে মানুষ চলাচল করতে পারছে না। বর্জ্যগুলো শরীরের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এতে মানবদেহের ত্বকের নানা সমস্যা হচ্ছে। চর্মরোগ, অ্যাগজিমা, চুলকানি, দানা দানা গোটাসহ বিভিন্ন লক্ষণ দেখা দিচ্ছে। এর প্রতিকার চেয়ে গত ২৯ মে-২০১৯ তারিখ এলাকাবাসীর পক্ষে আসাদুলøাহ মাসুম জেলা প্রশাসকের নিকট লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন।
স্থানীয় লোকজনের দীর্ঘদিনের অভিযোগের প্রেক্ষিতে সম্প্রতি প্রোটিন হাউজ ও ডায়মন্ডের মুরগির বর্জ্য ও বিষাক্ত পানি দ্বারা এলাকার পরিবেশ ও ফসলের ক্ষয়-ক্ষতি ও মানুষের দুর্ভোগ দেখতে খামার ও আশপাশের এলাকা সরেজমিনে পরিদর্শন করেছেন, কাপাসিয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আলহাজ্ব অ্যাড. মো: আমানত হোসেন খান, উপজেলা নির্বাহী অফিসার ইসমত আরা ও কাপাসিয়া থানার অফিসার ইনচার্জ মোঃ রফিকুল ইসলাম। তাঁরা স্থানীয় পরিবেশ দুষণের মাত্রা দেখে হতবাক হয়েছেন। পরে কাপাসিয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার গাজীপুরের পরিবেশ অধিদপ্তরকে বিষয়টি সরেজমিনে তদন্ত করার অনুরোধ করেন। তাঁর অনুরোধের প্রেক্ষিতে গাজীপুর পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিদর্শক শেখ মুজাহিদ সরেজমিনে প্রতিষ্ঠান দুটি তদন্ত করেন। তিনি জানান, তদন্ত করে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে। প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষ পরিবেশ অধিদপ্তরের দেয়া ছাড়পত্রের শর্ত ভঙ্গ করেছে। তাদের মুরগীর লিটারের পানি প্রতিষ্ঠানের জমির বাইরে আশপাশের অন্য মানুষের জমিতে প্রবাহিত হওয়ায় স্থানীয় লোকজন ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে এবং পরিবেশ দুষণ হচ্ছে। তাই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য তদন্ত প্রতিবেদন ঢাকায় পাঠানো হবে।
প্রতিষ্ঠান দুইটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক কায়সার আহমেদ এসব বিষয়ে বলেন, এলাকাবাসীর এসব অভিযোগ সঠিক নয়। আমার প্রতিষ্ঠানের আশেপাশে কোন নদী, খাল বা বিল নেই। কোন পরিবেশ দুষণ হচ্ছে না। সরকারী অনুমতি নিয়ে প্রতিষ্ঠান দুটি চলছে। বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সব ব্যবস্থাই আছে। এখানে অর্গানিক ফার্টিলাইজার ফ্যাক্টরীর কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন আছে। একটি মহল ব্যবসায়িক সুবিধা না পেয়ে নানা অপপ্রচার করছে।
কাপাসিয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানর আমানত হোসেন খান বলেন, স্থানীয় লোকজনের অনেক অভিযোগ রয়েছে। পরিবেশের মারাত্বক দুষণ হচ্ছে। উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।
গাজীপুর জেলা প্রশাসক ড. দেওয়ান মুহাম্মদ হুমায়ুর কবীর বলেন, সরেজমিন এবিষয়ে অনুসন্ধান করা হয়েছে। কেউ অন্যায়ভাবে কোন প্রতিষ্ঠান চালাতে পারনে না। স্থানীয় লোকজনের দূর্ভোগ লাঘবে সব রকম আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।