গণবানী ডটকম:
জেলা হিসাবে গাজীপুরের যাত্রা শুরু ১৯৮৪ সালের ১ মার্চ। এর আগে ১৯৭৮ সালের ১৮ ডিসেম্বর গাজীপুরকে মহকুমা ঘোষণা করা হয়। এর পূর্বে গাজীপুর জেলা সদর পরিচিতি ছিল জয়দেবপুর নামে। জয়দেবপুর ছিল তখন থানা। প্রশাসনিক বিকেন্দ্রকরণের আওতায় ১৯৭৮ সালের ১৮ ডিসেম্বর তৎকালীন ঢাকা সদর উত্তর মহকুমার প্রায় সবটুকুৃ এলাকা নিয়ে গাজীপুর মহকুমা গঠন করা হয়। এর অন্তর্ভুক্ত হয় পাঁচটি থানা (উপজেলা) ও টঙ্গী পৌরসভা। থানাগুলো হচ্ছে জয়দেবপুর, কালিয়াকৈর, শ্রীপুর, কাপাসিয়া ও কালীগঞ্জ। গাজীপুরের মোট আয়তন হচ্ছে এক হাজার আটশত দশমিক চার সাত বর্গ কিলোমিটার এবং বর্তমানে এর জনসংখ্যা হচ্ছে প্রায় ৪০ লÿ। জেলা হিসাবে গাজীপুর নূতন হলেও এর রয়েছে সমৃদ্ধ ও কালোর্ত্তীণ ইতিহাস ও ঐতিহ্য। ঐতিহাসিক জনপদ হিসাবে সুদুর অতীত থেকে এলাকাটি পরিচিত ছিল কখনো “ভাওয়াল” কখনো “ভাওয়াল পরগনা” আবার কখনো “ভাওয়াল বাজুহা” নামে।
ভাওয়াল নামের জনপদের প্রথম উলেøখ পাওয়া যায় খ্রীষ্টায় ৭ম শতাব্দীতে। গ্রীক পরিব্রাজক ম্যাগান্থিসের (৩০২ খ্রীঃপৃঃ) ইন্ডিয়া এবং হিউ ন সাঙ এর বিবরণীতে প্রথম এ জনপদের উলেøখ পাওয়া যায়। সে সময় এ অঞ্চল ÿুদ্র ÿুদ্র সমন্ত রাজ্যে বিভক্ত ছিল এবং এসব রাজ্যকে “চেদী রাজ্য” বলে উলেøখ করা হতো। সে সময়কার অন্তত পাঁচজন সামন্ত রাজার কথা জানা যায়। এরা হলেন শিশুপাল, যশোপাল, প্রতাপ, মহেন্দ্র ও খাইডা ডোসকা। এসব ÿুদ্র রাজাদের উলেøখ পাওয়া যায়। ডি সি সেনের হিস্টি অব ওল্ড বেঙ্গল, যতীন্দ্র মোহন রায়ের ঢাকার ইতিহাস এবং জেমস টেলরের টফোগ্রাফী অব ঢাকায়। দশম শতাব্দীতে এসব রাজাদের পতন ঘটে এবং হিন্দু ধর্মাবলম্বী সেন রাজাদের অধীনে চলে যায এ অঞ্চল। পরবর্তীতে প্রায় ১২০ বছর সেন রাজারা এ এলাকা শাসন করেন। পরে সেন রাজাদের শাসন ÿমতা দুর্বল হয়ে যাওয়ায় ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে শাসন ÿমতা চলে যায় মুসলমান শাসকদের হাতে।
ভাওয়াল এ নামটির প্রথম সুস্পষ্ট উলেøখ পাওয়া যায় সম্রাট আকবরের আমলে দুটি গ্রন্থে (১) আকবরের নবরতেœর অন্যতম তোভরমলের ওয়াসিম তুমর জুমা এবং (২) ইতিহাস প্রতা আবুল ফজলের আইন ই আকবরী গ্রন্থে। ‘ভাওয়াল’ এ নামটির উৎস নিয়েও রয়েছে নানার জনের নানান অভিমত। শ্রী যতীন্দ্র মোহন রায় ঢাকার ইতিহাস গ্রন্থে ভাওয়াল নামকরণ প্রসঙ্গে লিখেছেন- ‘প্রবাদ আছে কুরুÿেত্র যুদ্ধের সময় ভদ্রপাল বা ভবপাল দেশের রাজা কুরুকূলপতি দুর্যোজনের পাশে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। এখানে বর্ণিত ভদ্রপাল বা ভবপাল থেকে উৎপত্তি হতে পারে ভাওয়াল নামটি। শ্রী রামকমল সেন তাঁর রচিত অভিধানের ভূমিকায় মহাভারতের উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছেন- মহাভারতে বর্ণিত ভগদত্তের রাজধানী ছিল ‘ভগালয়’। এ থেকে ভাওয়াল নামের উদ্ভব বলে কেউ কেউ মনে করেন। এছাড়া ব্রÿান্ড পুরানে ‘ভদ্র’ নামে একটি প্রদেশের উলেøখ পাওয়া যায়। তাই ‘ভদ্র’ থেকেও ভাওয়াল নামটি আসতে পারে এমন অভিমত কারো কারো। অবশ্য অন্য আরেক দল মনে করেন যেহেতু এ এলাকার জমিজমা বহু আলযুক্ত তাই বহু আলযুক্ত ভূঁইয়ের সঙ্গে সমীকৃত হয়ে এলাকার নাম হয়েছে ‘ভাওয়াল’। অর্থাৎ ভাওয়াল শব্দটি সংস্কৃত ভূ-আল শব্দের বিকৃত রূপ। শব্দটি আদিতে ছিল ভূয়াল অর্থাৎ আলযুক্ত ভূমি। বহু বছরে লোক মুখে প্রচারিত হতে হতে শব্দটি শেষে দাঁড়িয়েছে ভাওয়াল। তবে এসব মতের সমর্থনে জোরালো কোন যুক্তি পাওয়া যায় না। বরং ভাওয়াল নামের স্বপÿে যে জোরালো যুক্তি পাওয়া যায় তা হল এ এলাকার এক সময়ের শাসক গাজী বংশের এক সার্থক পুরুষ ‘ভাওয়াল গাজী’র ও নামানুসারে এ এলাকার নামকরণ করা হয় ‘ভাওয়াল’। গাজী বংশের প্রতিষ্ঠাতা শাহকারফরমা সেন বংশের শাসনামলেই এ অঞ্চলে এসেছিলেন ইসলাম ধর্ম প্রচারের জন্য। কালীগঞ্জের চৌড়া বা চৈরা গ্রামে তিনি আ¯Íানা স্থাপনা করেন। অবশ্য আরেক দলের মতে ‘পাহলোয়ান গাজী’ বা ‘পহন্নানসা গাজী’ হচ্ছেন গাজী বংশের প্রতিষ্ঠাতা। তার পুত্র ‘কাইউম খাঁ গাজী’ বা ‘ শাহকারফরমা গাজী’। তাদের উত্তর পুরুষ । ভাওয়াল গাজী দিলøীর সম্রাট শের-শাহের কাছে থেকে এ অঞ্চলের বা পরগনার জায়গীরদারী লাভ করেন এবং নিজের নামানুসারে এলাকার নাম রাখেন ‘ভাওয়াল’।
এ গাজী বংশের শেষ শাসক দৌলত গাজী ১৭০৯ সালে জায়গীরদারী লাভ করেন। ১৭৩৬ সালে তিনি পবিত্র হজব্রত পালনের জন্য মক্কা শরীফ গমন করেন। দৌলতগাজী মুর্শিদাবাদ নবাব কোর্টে এক মামলায় কুশধ্বস রায়ের বিচÿতায় জয়লাভ করার পর তাকে দেওয়ান পদে বহাল করেন। তার মৃত্যুর পর তার পুত্র বলরাম রায় পিতৃপদে বহাল হন। তখন ছিল পাঁচশালা বন্দোবস্থ। দৌলত গাজীর অবর্তমানে বলরাম কৌশলে খাজনা বাকী রেখে নিলাম ডাকে অংশ নিয়ে ১৭৩৮ সালে অন্য দুজনের সঙ্গে মিলে ভাওয়ালের জমিদারী ক্রয় করে নেন। তখন তাদের বাসস্থান ছিল চাঁদনা গ্রামে। বলরাম রায়ের মৃত্যুর পর তার পুত্র শ্রীকৃষ্ণ রায় জমিদার হন এবং তিনি কিছুদিন চাঁদনা গ্রামে বসবাসের পর পার্শবর্তী ‘পীড়াবাড়ী’ বা ‘পীরবাড়ী’ নামক স্থানে বসতবাড়ী নির্মাণ করেন। শ্রীকৃষ্ণ রায়ের মৃতু্যূর পর তার পুত্র জয়দেব নারায়ণ জমিদার হন এবং তার নামানুসারে এলাকার নাম রাখেন ‘জয়দেবপুর’।
ভাওয়াল রাজাদের শাসনকার্যের কেন্দ্র মূল ছিল জয়দেবপুর। পরে এটি থানার মর্যাদা পায়। ্ জয়দেবপুরকে সদর হিসেবে ধরে ১৯৭৮ সালের ১৮ ডিসেম্বর গাজীপুর মহকুমা গঠন করা হয়। সে সময় নবসৃষ্ট মহকুমার নামকরণের জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়েছিল। কমিটির বৈঠকে এলাকার অতীত ইতিহাস ও ঐতিহ্য পর্যালোচনা করে প্রায় পাঁচশত বছর যারা এলাকা শাসন করেছেন তাঁদের অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে গাজীদের কথা স্মরণ করে নতুন করে মহকুমার নামকরণ করা হয় গাজীপুর। পরে গাজীপুর মহকুমা ১৯৮৪ সালের ১ মার্চ জেলায় উন্নীত হয়। অবশ্য পাকি¯Íানী আমলের শেষের দিকে যখন বাঙালিরা তাদের স্বাধীকার স্বাধীনতা আন্দোলনে ছিল দুর্বার তখন দাবী উঠেছিল এ এলাকাকে জেলায় উন্নীত করার এবং তখন এলাকাবাসীদের পÿ থেকে এলাকার নামকরণ করা হয়েছিল ‘ভাওয়ালগড় জেলা’। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ‘গাজীপুর’ এ নামেই এলাকার নামকরণ করা হয়।