গণবাণী ডট কম:
প্রলংকারী ঘূর্ণিঝড় সিডর ও আইলার ক্ষত কাটতে না কাটতেই আবারও আঘাত হানে অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় ‘বুলবুল’। অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় বুলবুল ভারতীয় উপকূল অতিক্রম করে বাংলাদেশে প্রবেশের সময় ঢাল হিসেবে কাজ করেছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সুন্দরবন। সিডর, আইলার পর বুলবুলের চোখে চোখ রেখে এবারও অপরাজেয় সুন্দরবন। আর এর ফলে লোকালয়ে ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানির শঙ্কা অনেকটাই কমে এসেছে বলে মনে করছেন আবহাওয়াবিদ ও বনকর্মী এবং স্থানীয়রা ।
বুলবুলের শক্তি যখন সর্বোচ্চ মাত্রায় ছিল, তখন ঘণ্টায় দেড়শ কিলোমিটার গতির বাতাস নিয়ে উপকূলের দিকে ধেয়ে আসছিল এ ঝড়। তবে উপকূল অতিক্রম করার আগে আগে এর শক্তি কিছুটা কমে আসে। ঘণ্টায় ১১৫ কিলোমিটার থেকে ১২৫ কিলোমিটার বেগের বাতাসের শক্তি নিয়ে শনিবার রাত ৯টায় আঘাত হানে ভারতীয় উপকুলে। ঘূর্ণিঝড় ‘বুলবুল’ প্রথমে ভারতীয় অংশের সুন্দরবনের সাগরদ্বীপে আঘাত হানে। এরপর রাত সাড়ে ১০টার দিকে এটি বাংলাদেশের পূর্ব সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জের দুবলার চরে ঢুকে পড়ে। দুই দেশের সুন্দরবনের গাছপালায় বাধা পেয়ে দুর্বল ‘বুলবুলের’ কেন্দ্রে বাতাসের গতিবেগ ঘণ্টায় প্রায় ২০ কিলোমিটার কমে যায়। এর আগে ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর ঘূর্ণিঝড় সিডর এবং ২০০৯ সালের ২৫ মে ঘূর্ণিঝড় আইলা একইভাবে সুন্দরবনে বাধা পেয়ে দুর্বল হয়ে পড়েছিল। তারপর শক্তি হারিয়ে এটি পরিণত হয় স্থল নিম্নচাপে।
ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের কারণে সুন্দরবন সংলগ্ন উপকূলীয় জেলাগুলোতে গত শুক্রবার বেলা ১২টার পর থেকেই বৃষ্টিপাত শুরু হয়। শনিবার বিকালের পর থেকেই বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বাড়তে থাকে। রাত সাড়ে ১০টার দিকে ঘূর্ণিঝড় বুলবুল সুন্দরবনের দুবলার চরে আঘাত হানার পর থেকেই দমকা হাওয়ার সঙ্গে প্রবল বৃষ্টিপাত শুরু হয়।
সুন্দরবন উপকূলকে লণ্ডভণ্ড করে দেওয়ার হুমকি নিয়েই ধেয়ে আসা ঘূর্ণিঝড় ‘বুলবুল’কে রুখে দিতে সরকারের নানা তোড়জোড়, সর্বাত্মক প্রস্তুতি ছিল। নিরাপদে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল সুন্দরবন উপকূলের ৫ লক্ষাধিক মানুষকে। প্রস্তুত ছিল ১০টি যুদ্ধজাহাজ। সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলা, উদ্ধার তৎপরতা ও জরুরি ত্রাণ বিতরণের জন্য প্রস্তুত ছিল সেনাবাহিনী। খুলনাসহ উপকূলীয় জেলার বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ছুটিও বাতিল করা হয়।
খুলনা জেলা আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবহাওয়াবিদ আমিরুল আজাদ জানান, শনিবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে ঘূর্ণিঝড় বুলবুল সুন্দরবন উপকূলে প্রথম আঘাত হানে। রাত তিনটার দিকে সাতক্ষীরার শ্যামনগর ও কয়রা অতিক্রম করে ঘূর্ণিঝড়টি খুলনা, মোংলা, বাগেরহাট ও পিরোজপুরের দিকে ধাবিত হয়। ভোর ৫টার দিকে ঘূর্ণিঝড়টি ৬০ কিলোমিটার বেগে খুলনা, মোংলা, বাগেরহাট ও পিরোজপুরের ওপর দিয়ে বয়ে যায়। তবে নদীতে জোয়ার না থাকায় আইলার মত জলোচ্ছ্বাসের ঘটনা ঘটেনি।
এদিকে, পূর্বাভাসে যতটা ‘গর্জন’ ছিল, বাস্তবে ততটা বর্ষেনি ‘বুলবুল’। উপকূলের ২০০ কিলোমিটারে প্রবেশের পথে শক্তি কমতে থাকে। স্থলভাগে ‘ছোবল’ মারার সময় ঘূর্ণিঝড়টির গতি আরও কমে যায়। রবিবার সকাল থেকে ঘূর্ণিঝড়টি খুলনাঞ্চল অতিক্রম করে ‘স্থল নিম্নচাপ’ পরিচয়ে।
“সুন্দরবন এ ঘূর্ণিঝড়ের বাতাসের গতিবেগ কমিয়ে দিয়েছে। খুলনা অঞ্চলে যখন এসেছে, ততক্ষণে অনেকটা দুর্বল হয়ে পড়ে। এ কারণে বাংলাদেশে ততটা ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। সরাসরি এলে ক্ষয়ক্ষতি অনেক বেশি হতে পারত।”
সাম্প্রতিক অতীতে ২০০৯ সালের মে মাসে ঘূর্ণিঝড় আইলা এবং ২০০৭ সালের নভেম্বরে ঘূর্ণিঝড় সিডরও স্থলভাগে উঠে এসেছিল সুন্দরবন উপকূল দিয়ে। এর মধ্যে আইলায় বাতাসের গতি ছিল ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ১২০ কিলোমিটার। আর সিডরের শক্তি ছিল তার দ্বিগুণেরও বেশি, ঘণ্টায় ২৬০ কিলোমিটার।
দক্ষিণের উপকূলীয় এলাকাগুলোর মানুষদের জীবনে ‘সিডর’ এক দুঃসহ স্মৃতির নাম। ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর বাংলাদেশের সুন্দরবন সংলগ্ন উপকূলীয় এলাকায় আঘাত হানে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় সিডর।
প্রলয়ঙ্করী সিডরে মৃত্যু হয় প্রায় সাড়ে তিন হাজার মানুষের। কিন্তু আরও বহু মানুষ বেঁচে যায় সুন্দরবনের কারণে। এই ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে সেই ঝড়ে, ভেঙে পড়ে হাজার হাজার গাছপালা।
দুর্যোগ প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “সুন্দরবন সবুজ বেষ্টনী হিসেবে কাজ করে। এর ওপর অনেক অত্যাচার হয়। এখানে আরো গাছ লাগিয়ে সক্ষমতা বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হবে।” সূত্র : বিভিন্ন গণমাধ্যম।
উল্লেখ্য, এবারের ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের নাম দিয়েছেন পাকিস্তানের আবহাওয়াবিদরা। জাতিসংঘের আওতায় গঠিত সংগঠন ইউএনএস্কেপের মাধ্যমে দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ার আবহাওয়াবিদরা বঙ্গোপসাগরে সৃষ্টি হওয়া ঘূর্ণিঝড়গুলোর নামকরণ করে থাকেন।