গণবাণী ডট কম:
তার নাম হিরোফা। বয়স প্রায় ৪০ বছর। পেশা ছিলো টেইলর। স্বামী ও দুই সন্তান নিয়ে ভালই চলছিল তার সুখের সংসার জীবন। এমনই সাধারণ জীবন যাপন করা এক নারী হিরোফা কিভাবে প্রথমে খুনী হলো এবং পরে লাশ গুম করার মাধ্যমে অপরাধ চাঁপা দেয়ার চেষ্টা করেছে তার লোম হর্ষক বর্ণনা তুলে ধরা হয়েছে গাজীপুর জেলা পুলিশের ফেসবুক একাউন্টে।
ঘটনাটি গাজীপুরের শ্রীপুর থানার। শ্রীপুর থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) মনিরুজ্জামান খানের নেতৃত্বে পুলিশ একটি ক্লু লেস হত্যা মামলার রহস্য উদঘাটন করতে গিয়ে যে সব তথ্য পেয়েছেন তা থেকে বাস্তব্ ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে।
হিরোফার জীবন যুদ্ধে টিকে থাকার লড়াইয়ের মধ্যে সংসারের জন্য একদিন কিছু টাকা প্রয়োজন হয়ে পড়ে। সংসারের প্রয়োজন মিটাতে হিরোফা সুদে টাকা ঋণ নিতে যার মানিকের কাছে। এ সূত্রে পরিচয় হয় মানিকের সাথে। মানিকের পুরো মোঃ মানিক মিয়া। তার বয়স ৫৫ বছর। তিনি গাজীপুরের শ্রীপুরের কেওয়া পশ্চিম খন্ড এলাকার মৃত সাহাজ উদ্দিনের ছেলে।
মানিক অন্য পেশার পাশাপাশি সুদে অর্থ বিনিয়োগ করে। হিরোফাকেও লাভে টাকা দেয় মানিক। প্রয়োজন শেষে উচ্চসুদ সহ মানিকের ঋণ পরিশোধ করে হিরোফা। প্রয়োজনে টাকা পেয়ে উপকৃত হয় হিরোফা। তার তার মধ্যে মানিকের প্রতি কৃতজ্ঞতা বোধ কাজ করে। একারণে পরিচয়ের সুবাদে বিভিন্ন মহিলাদের মধ্যে উচ্চসুদে ঋণ দেওয়ার কাজে হিরোফাকে কাজে লাগাতো মানিক। ভালো লাভ দেখে হিরোফাও এই ব্যবসায়ে আগ্রহী হয়। সংসারের উন্নতির কথা চিন্তা করে, একটু সচ্ছলতার আশায় হিরোফা নিজের নামে বিভিন্ন ব্যাংক ও এনজিও থেকে টাকা ঋণ হিসাবে উত্তোলন করে মানিকের সাথে সুদে বিনিয়োগ করে সে। এভাবেই তাদের মধ্যে সম্পর্ক ভালো হয়। উকিল বাবা ও মেয়ের সম্পর্ক তৈরী হয় তাদের মধ্যে। সরল বিশ্বাসে পিতা মেয়ের সম্পর্ক বিশ্বাস করে হিরোফা।
কিন্তু কিছুদিন পর থেকেই শুরু হয় সমস্যা। হিরোফার মাধ্যমে ঋণ নেয়া কোন ঋণ গ্রহীতা ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হলে হিরোফাকে চাপ দেয় মানিক। ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হলে বিভিন্ন সময় হিরোফার কাছ থেকে ব্ল্যাংক চেক নেয় মানিক। এভাবে হিরোফার ব্যাংক এবং এনজিওর ঋণও বাড়তে থাকে। আসতে থাকে ব্যাংকের নোটিশ। মানিকের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে কিছু কিছু ব্যাংক লোন পরিশোধ করে সে। এভাবেই মানিকের উপর হিরোফার নির্ভরশীলতা বেড়ে যায়।
একদিন মানিক তার অসুস্থতার কারণে চিকিৎসার জন্য তার সাথে ময়মনসিংহ যেতে বলে হিরোফাকে। মানিক উকিল বাবা, তাই সরল বিশ্বাসেই যেতে রাজি হয়। ডাক্তার এর এপোয়েনমেন্ট একটু বিলম্ব হওয়ায় আশ্রয় নেয় হোটেলে। মানিক হঠাৎ তার রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়। বিভিন্ন ধরণের কুপ্রস্তাব দেওয়া শুরু করে। তার সকল ঋণ পরিশোধ করে দিবে ও বাড়ি করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয় মানিক। নানা চাপ ও ভয়ভীতির কারণে পরিস্থিতির শিকার হয়ে হিরোফা বাধ্য হয় মানিকের সাথে শারীরিক সম্পর্ক করতে। এরপর প্রতিনিয়ত হিরোফাকে এ অনৈতিক কাজে ব্যবহার করত মানিক। অপরদিকে, হিরোফার ঋণ তো পরিশোধ করতোই না বরং নিজের প্রভাব খাটিয়ে অন্য এনজিও আর ব্যাংক থেকে ঋণ নিতেও বাধা দিতো সে। হিরোফাকে পুতুলের মত ব্যবহার করা শুরু করে সে। এমনকি মানিককে বাবার পরিচয় দিয়ে পাসপোর্টও করে। চিকিৎসার নামে ভারত গিয়েও মানিক হিরোফার সাথে একই কক্ষে থাকে। তার সাথে অনৈতিক কাজ অব্যাহত রাখে। স্বামীর সাথে বিচ্ছেদ করে বিয়ের প্রস্তাব ও দেয় মানিক। হিরোফা রাজি না হওয়ায় ব্ল্যাংক চেক দিয়ে মামলার ও ভয় দেখায়। একপর্যায়ে মানিক হিরোফাকে তাহার স্বামী ও সন্তান রেখে তাকে বিয়ে করার জন্য চাপ দেয়। হিরোফা এর নিকট হতে কয়েকটি ব্লাংক চেক ও নেয় মানিক। মানিকের সাথে দৌহিক মিলনে রাজি না হলে এবং মানিককে বিয়ে না করলে হিরোফার বিরুদ্ধে আদালতে ১ কোটি টাকা পায় মর্মে চেক মামলা করবে বলে হুমকি দেয় মানিক। নিরুপায় হিরোফা অনেককে বিষয়টি জানালেও কেও কোন সমাধান দিতে পারে না।
উপায় না পেয়ে তার রাস্তা থেকে মানিককে সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করে সে। স্থানীয় কিছু লোক কে টাকা দিয়েও কোন কাজ হয় না। হিরোফা এই অবৈধ সম্পর্ক ও ঋণের যন্ত্রনা থেকে মুক্তি এবং স্বাভাবিক জীবন ফিরে পাওয়ার জন্য বিষয়টি তার ভাই সোহেল, স্বামী লিটন, পিতা আনোয়ার হোসেনকে জানায়। তাদের সাথে পরামর্শ করে। পরে ৩০ হাজার টাকা দিয়ে রেজাউলকে ভাড়াটিয়া কিলার হিসাবে ভাড়া করে। ফেব্রুয়ারী মাসের ১১ তারিখ পরিকল্পনা অনুযায়ী ফিরোফা ও তার স্বামী লিটন প্রথমে তার বাবা আনোয়ারের বাড়ি যায়। আনোয়ারের অসুস্থতার কথা বলে মানিককে সেখানে ডাকে হিরোফা। মানিক যাওয়ার পর রেজাউল ঐ বাড়ী যায়। সবাই একসাথে নাস্তা করার পর কথা বলতে বলতে হটাত সবাই মানিকের উপড় ঝাপিয়ে পড়ে। প্রথমে তাকে গামছা দিয়ে শ্বাস রোধ করে হত্যা করে। তারপর লাশ টেনেনিয়ে যায় বাথরুমের ট্যাংকির কাছে। সেখানে ছুড়ি দিয়ে গলা কেটে ট্যাংকিতে ফেলে দেয়।
এর প্রায় ৩দিন পর আনোয়ার হোসেন যখন বাথরুমে যায় সেখানে প্রচুর গন্ধ পায়। তখন রেজাউলকে নিয়ে গভীর রাতে ট্যাংকি থেকে লাশ উঠিয়ে পাশের একটি গর্তে মাটি চাপা দিয়ে চলে যায়।
এরমধ্যে ঘটনার পর হিরোফা তার পরিবার সহ কিছুদিন তার ভাই সোহেলের বাড়ি থাকে ও তার পর ঠাকুরগাও চলে যায়। মানিকের মোবাইল ব্যবহার করে মানিকের ছেলে মিলনকে টাকা চেয়ে ও মামলা উঠানোর হুমকি দিয়ে মেসেজ দেয় হিরোফা। এদিকে বাবাকে না পেয়ে থানায় সাধারন ডায়েরী করে মানিকের ছেলে মিলন।
প্রায় ১৫ দিন পর গর্ত থেকে শিয়াল লাশ টি একটু উঠিয়ে ফেললে গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে। আনোয়ার দ্রুত আবারো তার সহযোগীদের নিয়ে গভীর রাতে গর্তথেকে লাশটি উঠিয়ে পলিথিনে মুড়িয়ে পাশের ডোবায় কাদায় চাপা দিয়ে রাখে। পরেরদিন পাশের বাড়ির এক মহিলা গরুকে গোছল করাতে গিয়ে লাশটি ভেসে উঠে। তখন পুলিশ এসে লাশটিকে হাত পা ও মাথা বিহীন উদ্ধার করে এবং ময়নাতদন্তের জন্য হাসপাতালে পাঠায়। নিখোজ জিডির ভিত্তিতে পুলিশ মানিকের ছেলে মিলনকেও লাশটি দেখতে পাঠায় কিন্তু লাশটি অনেক বিকৃত হয়ে যাওয়ায় ছেলে তার বাবাকে চিন্তে পারে না।
এরপর পুলিশ পরিদর্শক মনিরুজ্জামান নিখোজ ডায়েরীর ঘটনা তদন্তে নামেন। অনেক লোকের সাথে মানিকের খারাপ সম্পর্ক থাকায় সন্দেহভাজন লোকের সংখ্যাও বেশী। সবকিছু বিশ্লেষন করে হিরোফাকে টার্গেট করেন তিনি। হিরোফা ও মানিক কোথাও গোপনে সংসার করছে বলেও ধারনা করেন অনেকে। অনেক খোজাখুজির পর হিরোফার ভাই সোহেলের খবর পাওয়া যায়। সোহেলের কথা মত প্রথমে পঞ্চগড় ও পরে ঠাকুরগাও অভিযান চালিয়ে হিরোফাকে আটক করে পুলিশ।জিজ্ঞাসাবাদে সে মানিককে হত্যার দায় স্বীকার করে। কিন্তু সে তার পরিবারের অন্য সদস্যদের রক্ষা করতে প্রথমে অন্যলোকদের ও পরে শুধু নিজের সংশ্লিষ্টতার কথা বলে তদন্তকে অন্য দিকে নিয়ে যায়।কিন্তু পুলিশ বিভিন্ন কৌশলে একেরপর এক প্রকৃত অপরাধীদের চিহ্নিত করে এবং একাধিক অপারেশন চালিয়ে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারকৃত সকল আসামী পুলিশের কাছে ঘটনা স্বীকার করে।
পরবর্তীতে মানিকের ছেলে মিলন থানায় একটি হত্যা মামলা করেছেন। এ মামলায় গ্রেফতারের পর সোমবার হিরুফা, হিরুফার পিতা আনোয়ার এবং ভাড়াটিয়া কিলার রেজাউল বিজ্ঞ আদালতে ফৌ. কা. বি. ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীদে মানিক হত্যার লোমহর্ষকর ঘটনার বিস্তারিত বিবরন দেন। মামলাটি তদন্তাধীন আছে। আরো তথ্য উদ্ঘাটন এবং আসামী গ্রেফতারের অভিযান অব্যাহত আছে।