গণবাণী ডট কম:
আজ পয়লা ভাদ্র। বাংলাদেশের ছয় ঋতুর মধ্যে বিশেষ একটি ঋতু শরৎকাল। ঋতুর বিভাজনে ভাদ্র-আশ্বিন আমাদের দেশে শরৎকাল। আকাশে দিকে তাকালে নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা আর নদ-নদী তীরের সাদা কাশফুল দেখলেই বোঝা যায় এখন শরৎকাল। কাশফুল শরতের আগমনের প্রতীক। পদ্মা-মেঘনা-যমুনা-ব্রক্ষ্মপুত্র-তিস্তার তীরে বাতাসে কাশফুল দোলে মোহনীয় ভঙ্গিমায়। শরৎকে বলা হয় ঋতুরানী। শরৎকালের প্রকৃতি হয় কোমল-শান্ত-স্নিগ্ধ-উদার। অপার সৌন্দর্য নিয়ে ঋতুর রাণী শরতে রকমারী ফুলে ফুলে ভরে গেছে দেশের প্রকৃতি-নদীর চর-বনাঞ্চল।
আবহাওয়ার পরিবর্তনের বার্তা নিয়ে আসে শরৎকাল। একটু একটু শীত ফুল-পাখিদের কলতান এবং কৃষকরা নবান্নের ধানের প্রতীক্ষায় থাকে। একটি উৎসব মুখর পরিবেশের সৃষ্টি নিয়ে যেন শরৎকালের পথ চলা।কবির কবিতায়, লেখকের গদ্যে, শিল্পীর গানে গানে শরতের গল্পকাহিনী ফুটে ওঠে। তবুও যেন শরতের ইতিবৃত্ত হয় না শেষ। কেউ আবার বলে এটি ফুল আর পাখিদের মৌসুম। কারো কারো লেখায় দেখা গেছে সারা বিশ্বের কবি সাহিত্যিকরা শরৎকালের বিকেল বেলা খুব পছন্দ করে। পৃথিবীতে চারটি ঋতুর মধ্যে শরৎকাল অন্যতম একটি ঋতু। শরৎকে ঋতুর রানীও বলা হয়। শরতের সবুজ মাঠ, নীল আকাশ কাশফুল মনোরম এ দৃশ্য যেন সেই শৈশবকাল নিয়ে যায়।
শরৎকালকে বিশ্বের অনেক সাহিত্যিকদের লেখায় বেশ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। অনেক লেখক, কবির লেখায় শুভ্রতার প্রতীক হিসেবে শরৎকালকে আখ্যায়িত করেছেন। শরৎ নিয়ে বাংলা ভাষাভাষি কবিরা হাজারো কবিতা লিখেছেন। কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শরতের কবিতায় বলেছেন, ‘শরৎ তোমার অরুণ আলোর অঞ্জলি, ছড়িয়ে গেল ছাপিয়ে মোহন অঙ্গুলি।’ আর এভাবেই বাঙালির সামনে শরতের সৌন্দর্য উপস্থাপন করেছেন কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি বিভিন্নভাবে শরৎকাল নিয়ে নিজের আবেগকে তুলে ধরেছেন। বিদ্রোহ ও প্রেমের কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন ‘ওগো ও কাজল মেয়ে/ উদাস-আকাশ ছলছল চোখে তব মুখে আছে চেয়ে/ কাশফুল-সম শুভ্র ধবল রাশ রাঙা শ্বেত মেঘে/ তোমার তরীর উড়িতেছে পাল উদাস বাতাস লেগে’)। অথবা গেয়েছেন-শিউলী ফুলের মালা দোলে/শারদ রাতের বুকে ঐ। শরতের প্রথম প্রভাতে আজ সেই শিউলিফুল ফুটাবে। তার বিকশিত রূপ আর গন্ধ ছড়াবে বাতাসে। আমোদিত হবে প্রকৃতি সেই সাথে প্রফুল্ল এবং উৎফুল্লচিত্ত হয়ে উঠবে মানুষ এবং এই রসহীন নগর জীবনে যারা অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে, তারাও সচকিত হবে শরতের সুরভিতমাখা নিমন্ত্রণে। কবি জীবনানন্দ দাশ তাঁর প্রিয়তমাকে এ ঋতুর চরিত্রের সাথে তুলনা করেছেন। আহসান হাবীব বলেছেন; ‘এবার শরৎ রাত্রি স্বপ্ন নয় এনেছে সঙিন/ লণ্ঠিত স্বর্ণের শীষে সে স্বপ্ন রঙিন/ কেঁদে মরে-মৃত্তিকায় মিশে যায় ধীরে/ এবার শরৎ রাত্রি উদযাপিত হবে আঁখি নীরে’।
নির্মলেন্দু গুণ বলেন. ‘সবে তো এই বর্ষা গেল/ শরৎ এলো মাত্র/ এরই মধ্যে শুভ্র কাশে/ ভরলো তোমার গাত্র/ ক্ষেতের আলে মুখ নামিয়ে/ পুকুরের ঐ পাড়টায়/ হঠাৎ দেখি কাশ ফুটেছে/ বাঁশবনের ঐ ধারটায়/ আকাশ থেকে মুখ নামিয়ে/ মাটির দিকে নুয়ে/ দেখি ভোরের বাতাসে কাশ/ দুলছে মাটি ছুঁয়ে/ পুচ্ছ তোলা পাখির মতো/ কাশবনে এক কন্যে/ তুলছে কাশের ময়ূর চূড়া/ কালো খোঁপার জন্যে/–/ ইচ্ছে করে ডেকে বলি/ ওগো কাশের মেয়ে/ আজকে আমার চোখ জুড়ালো/ তোমার দেখা পেয়ে/ তোমার হাতে বন্দী আমার/ ভালোবাসার কাশ/ তাই তো আমি এই শরতে/ তোমার ক্রীতদাস’। কবি আকাশ নীল কবিতায় লিখেছেন-এখানে আকাশ নীল নীলাভ আকাশজুড়ে সজিনার ফুল/ফুটে থাকে হিম শাদা রং তার আশ্বিনের আলোর মতন।
প্রকৃতির এক বিচিত্র রূপ শরতের আগমনে হয়। কৃষকের ঘরে নতুন ধান আসে তারপর কত রকম পিঠা তৈরি হয়। আনন্দে উল্লাসিত মুখ ভরে প্রাণ জুড়ায় রকমারি পিঠায়। বাঙালির প্রতিটি ঘরে বয়ে আনে শরৎ ভিন্নমাত্রিক আনন্দ। সবার মনে রঙ্গ, রসের কোনো কমতি নেই। যারা সেই কবে পল্লীর সান্নিধ্য ছেড়ে জীবিকার তাগিদে ইট-পাথরের শহরে বসবাস করছে তারাও উপলব্ধি করবে সত্যিই শরৎ এসেছে আকাশে বাতাসে। শরতের আবহাওয়া এই মেঘ এই বৃষ্টি আবার কখনও রোদেলা হাসি। এ যেন মানুষ আর প্রকৃতির মাঝে লুকোচুরি খেলা। তবে আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এর গুরুত্ব দেখা গেলেও মধ্যপ্রাচ্যে এর তেমন একটা প্রভাব দেখা যায় না। ভাদ্র আশ্বিন বাংলায় ষড়ঋতুর তৃতীয় ঋতু হচ্ছে শরৎ। যদিও ইংরেজিতে বলা হয় ওটাম কিন্তু উত্তর আমেরিকায় শরৎকে বলা হয় ‘ফল’।