গণবাণী ডট কম :
যিনি গত একটি বছর গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলায় করোনায় আক্রান্ত পাঁচ শতাধিক ব্যক্তির চিকিৎসাসহ অন্যান্য বিষয়ে সার্বিক খোঁজ-খবর নিয়েছেন। সবরকম সহায়তার হাত বাড়িয়ে ছিলেন সেই সংসদ সদস্য, বঙ্গতাজ তাজউদ্দিন আহমদের কন্যা ও সাহিত্যিক সিমিন হোসেন রিমি ও তাঁর দুই ছেলে সস্ত্রীক করোনাভাইরাসে (কোভিড-১৯) আক্রান্ত হয়েছেন। গত ২৬ তারিখ থেকে সাংসদ রিমি করোনায় আক্রান্ত। আক্রান্ত হয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শে বাসায় আইসোলেশনে থেকে ৫ দিন চিকিৎসা নেয়ার পর আজ মঙ্গলবার দুপুরে তিনি রাজধানীর ইউনাইডেট হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন তাঁর স্বামী মোস্তাক হোসাইন।
তিনি আরো জানান, রিমির করোনা পজিটিভ ফলাফল পাওয়ার পর পরিবারের সদস্যরা নমুনা দিলে তাঁর দুই ছেলে রাজিব হোসাইন ও রাকিব হোসাইন সস্ত্রীক কোভিড-১৯ ধরা পড়ে। বর্তমানে তাঁরা হোম আইসোলেসনে রয়েছেন।
সাংসদের স্বামী মোস্তাক হোসাইন আরো জানিয়েছেন, সিমিন হোসেন রিমির সর্দি-জ্বর রয়েছে। গতকাল সোমবার রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা কিছুটা কমে গেলে রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসকের কাছে যান তিনি। সেখানে বেশ কিছু পরীক্ষা করান। আজ দুপুরে তিনি চিকিৎসকের পরামর্শে উক্ত হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।
তিনি আরো জানিয়েছেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ার জন্য সরকারি নিয়ম অনুযায়ী গত ২৫ মার্চ নমুনা দেন তিনি। তারপর দিন নমুনা পরীক্ষার ফলাফল পজিটিভ আসে। তখন থেকেই তিনি বাসায় হোম আইসোলেশনে থেকে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন। তাঁর সর্দি-জ্বর দেখা দেয়। তিনি আরো জানান, স্ত্রীসহ ছেলেরা এখন অনেকটাই সুস্থ্য আছেন। তাদের শারিরীক অবস্থা উন্নতির দিকে। তারা বাসায় হোম আইসোলেশনে থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন। তিনি তাদের সুস্থতার জন্য সকলের নিকট দোয়া চেয়েছেন।
জানা যায়, মানবিক কাপাসিয়া গড়ার রূপকার, যিনি গত একটি বছর কাপাসিয়া উপজেলায় করোনায় আক্রান্ত পাঁচ শতাধিক ব্যক্তির চিকিৎসাসহ অন্যান্য বিষয়ে সার্বিক খোঁজ-খবর নিয়েছেন। সবরকম সহায়তার হাত বাড়িয়ে ছিলেন সেই সংসদ সদস্য সিমিন হোসেন রিমি করোনায় আক্রান্ত হওয়ার খবরে কাপাসিয়া উপজেলা আওয়ামী পরিবার তথা কাপাসিয়াবাসীর মনে হতাশা ও উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে।
কাপাসিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ জানান, অসাধারণ মানবীয় গুণাবলীর অধিকারী এই সংসদ সদস্য‘র করোনায় আক্রান্ত হওয়ার খবরে তার নির্বাচনী এলাকা গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার সকল শ্রেণী-পেশার মানুষের মধ্যে হতাশা ও উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। তারা কাপাসিয়ার বিভিন্ন মসজিদে দোয়ার আয়োজন করছেন। অন্যান্য ধর্মীয় উপাসনালয়েও প্রার্থনার আয়োজন করা হয়েছে।
গত বছর দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরু পর কাপাসিয়া উপজেলায় ১০ এপ্রিল প্রথম কোভিড-১৯ রোগী শনাক্ত হয়। ওই সময় উপজেলার দস্যুনারায়ণপুর এলাকায় ছোঁয়া অ্যাগ্রো ফিড লিমিটেড কারখানায় ১৭ জন করোনা রোগী শনাক্ত হয়। এতে তখন উপজেলাজুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছিল।
উপজেলার করোনা জয়ী সাধারণ মানুষজন জানায়, সিমিন হোসেন রিমি ঝুঁকি নিয়ে তখন করোনা রোগীদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। প্রত্যেকের চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছেন। শুধু তাই নয়, দরিদ্র করোনা রোগীদের পরিবারের দায়িত্বও নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন রিমি। তিনি বাংলাদেশের মধ্যে কাপাসিয়া উপজেলাতেই প্রথম বেসরকারি উদ্যোগে একটি হাসপাতলে আইসোলেশন এর ব্যবস্থা করে সেখানে করোনা আক্রান্ত রোগীদের বিনামূল্যে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছেন। সংসদ সদস্য সিমিন হোসেন রিমি কাপাসিয়ায় করোনার সংক্রমণ রোধকল্পে নানারকম কার্যক্রম গ্রহণ করতে থাকেন। যার ফলশ্রুতিতে গাজীপুর জেলায় এখনো কাপাসিয়ায় করোনা সংক্রমনের সংখ্যা সর্বনিম্ন।
রোগীদের সেবা করতে গিয়ে কাপাসিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কর্মকর্তা আবদুস সালামসহ বেশ কয়েকজন ডাক্তার নার্স ওয়ার্ড বয় সহ প্রায় ৩৫ জন করোনা আক্রান্ত হন। তখন হাসপাতালের সেবা কার্যক্রম কিছুদিনের জন্য বন্ধ করে দেয়া হয়। এই সময়টাতে কাপাসিয়ার গর্ভবতী মায়েরা যাতে নিরবিচ্ছিন্নভাবে সেবা পেতে পারেন তার জন্য উপজেলার একটি বেসরকারি হাসপাতালের মাধ্যমে গর্ভবতী মহিলাদের সিজারিয়ান সহ প্রয়োজনীয় সকল সেবা বিনামূল্যে দেওয়ার ব্যবস্থা করে দেন এই সাংসদ। পরে রোগীদের সম্বন্ধে বিলের টাকা এই সাংসদ পরিশোধ করে দিয়েছেন।
কাপাসিয়ার গর্ভবতী মায়ের মা ও শিশুদের সেবা প্রদানের লক্ষ্যে তিনি সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন স্বাস্থ্য কার্ড নামে একটি সেবা চালু করেন। এই কার্ডের মাধ্যমে নির্দিষ্ট দিন ও সময় গর্ভবতী মা ও শিশুরা বিনামূল্যে সেবা পেয়ে থাকেন। এই সেবার মাধ্যমে গত প্রায় তিন বছর যাবত কাপাসিয়া উপজেলায় মাতৃমৃত্যুর হার শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে।
উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. আবদুস সালাম সরকার জানান, করোনা মহামারি শুরুর পর ঝুঁকিতে পড়ে গর্ভবতী মায়েরা। ঘরে ঘরে তাদের চিকিৎসা সেবা পৌঁছে দিতে ইউনিয়নভিত্তিক উদ্যোগ নিয়েছিলেন সাংসদ। ওই উদ্যোগে গত বছর থেকে এখন পর্যন্ত প্রসবকালে মাতৃমৃত্যু এখন শূণ্য। এছাড়া শিশুদের জন্য ঘরে ঘরে তিনি শিশুখাদ্য পৌঁছে দিয়েছেন।
করোনাকালীন কোন এক সন্ধ্যায় কাপাসিয়া উপজেলা নির্বাহি কর্মকর্তা মোসা: ইসমত আরা এই সাংসদকে মোবাইলে ফোন করেন। তখনও তার কন্ঠে উদ্বেগ আর আতঙ্ক প্রকাশ পাচ্ছিল। তিনি উদ্বিগ্ন কন্ঠে এই সাংসদের কাছে জানতে চান স্যার আমি এখন কি করবো? একটি মেয়ে ফোন করে তার মাকে বাঁচানোর আকুতি জানাচ্ছে। ওই মেয়ের মা নিঃশ্বাস নিতে পারছে না। ইউএনও আবার জানতে চান স্যার আমি এখন কি করবো? তখন এই সাংসদ তাকে বলেন, যে মেয়েটি তোমাকে ফোন করেছে তার নাম্বার আমাকে দাও। তারপর উক্ত মেয়ের নাম্বার নিয়ে তিনি নিজে ওই মেয়ের নাম্বারে ফোন করে মেয়ের সাথে কথা বলেন।
সংক্ষিপ্তভাবে ঘটনা শুনে তিনি বুঝতে পারেন উক্ত মহিলার শ্বাসকষ্ট হচ্ছে এবং তিনি নিঃশ্বাস নিতে পারছিলেন না। তখন এই সাংসদ তাকে ফোনে স্পিকার অন করে তার মায়ের কাছে রাখতে বলেন। তখন তিনি ওই মহিলাকে উপুড় হয়ে শুয়ে বুকের নিচে বালিশ দিয়ে মুখ হা করে জোরে জোরে নিশ্বাস নেয়ার পরামর্শ দেন। এভাবে কিছুক্ষণ করার পর উক্ত মহিলা একটু সুস্থ বোধ করেন। সেই করোনাকালীন সময়ে গভীর রাতের এই সঙ্কট মুহূর্তে উক্ত পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন এই সাংসদ। তিনি তৎকালীন গাজীপুর শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক এবং বর্তমান সিভিল সার্জন কে ফোন করে অ্যাম্বুলেন্স পাঠান। একই সাথে কাপাসিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে পিপিএ সংগ্রহ করে তা পরিয়ে উক্ত মহিলাকে গাজীপুর শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তির ব্যবস্থা করেন এবং উক্ত মহিলার জীবন রক্ষা করতে ভূমিকা রাখেন।
উপজেলা সদরের সাফাইশ্রী এলাকার সেই লুৎফুন্নাহার খানম জানান, গত ১৯ এপ্রিল গলা ব্যথা ও শ্বাসকষ্ট নিয়ে অস্থির হয়ে উঠছিলেন তিনি। তাঁর ছোট দুই মেয়ে কিছু বুঝে ওঠতে না পেরে কান্নায় ভেঙে পড়ছিল। ওই অবস্থায় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে জানানো হয়। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তা জানান সাংসদ সিমিন হোসেন রিমিকে। আর তা জেনেই ইউএনও’র কাছ থেকে মোবাইল নম্বর নিয়ে সাংসদ তাঁকে ফোন করেন। তাঁর অবস্থা জেনে দ্রুত অ্যাম্বুলেন্স পাঠান। প্রাথমিকভাবে তাঁকে নিয়ে যান শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে নমুনা দিলে কোভিড-১৯ ধরা পড়ে তাঁর। এরপর সেখান থেকে সাংসদ তাঁকে রাজধানীর কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তির ব্যবস্থা করে দেন। টানা ১৪ দিন চিকিৎসা পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠেন তিনি।
কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে গিয়ে কেঁদে ফেলেন লুৎফুন্নাহার খানম। তিনি জানান, রিমির মমতার আঁচল উপজেলার মাটিজুড়ে। মানবিক সেবকা দিয়ে এখন তিনি নিজেই আক্রান্ত। তিনি বলেন, ‘আমরা আল্লাহ’র কাছে তাঁর জন্য দোয়া করি। দোয়া চাই সবার কাছেই।’
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোসা. ইসমত আরা জানান, উপজেলাজুড়ে করোনা সংক্রমিতদের পাশে শুরু থেকেই সদা জাগ্রত সিমিন হোসেন রিমি। ঝুঁকি নিয়ে ঘরে ঘরে গিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছেন। নিজের উদ্যোগে অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে হাসপাতালে পাঠিয়েছেন রোগীদের। মানবিক সেবা দিয়ে এখন তিনি নিজেই আক্রান্ত।
সেই সময় করোনা সংক্রমিত হয়ে বেশি অসুস্থ হয়ে পড়া একজন শ্রমিককে ঢাকায় পাঠিয়ে কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে ভর্তি করে তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। শুধু তাই নয় প্রতিদিন একাধিকবার ফোনে তার সাথে যোগাযোগ রাখতেন তার সব রকম প্রয়োজন ও চাহিদা খোঁজখবর নিতেন এবং তা পাঠানোর ব্যবস্থা করতেন। এই ঘটনার স্মৃতিচারণ করে এই সাংসদ একদিন বলেছিলেন তখন আমি তার জন্য আমার ব্যক্তিগত মোবাইলের ব্যবহৃত চার্জারটিও তাকে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম।
সংসদ সদ্যস্যের এসব মানবিক সেবার কারণে তিনি কাপাসিয়াবাসীর কাছে আমাদের মাদার তেরেসা হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছেন।