গণবাণী ডট কম:
গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী (স্বতন্ত্র) প্রার্থী, সাবেক মেয়র মো: জাহাঙ্গীর আলমের মনোনয়নপত্র বাতিল করা হয়েছে। একটি খেলাপি ঋণগ্রহীতা প্রতিষ্ঠানের ঋণের জামিনদার হওয়ার কারণে জাহাঙ্গীর আলমের মনোনয়ন বাতিল করেন গাজীপুর সিটি নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা ফরিদুল ইসলাম। মনোনয়নপত্র বাছাইয়ের প্রথম দিনে জাহাঙ্গীর আলমের উপস্থিতিতে ওই কর্মকর্তা এই আদেশ দেন। তবে তার মা জায়েদা খাতুনের মনোনয়নপত্র বৈধ ঘোষণা করা হয়েছে।
বাছাইকালে জাহাঙ্গীর ছাড়াও আরো স্বতন্ত্র প্রার্থীর মনোনয়ন পত্র বাতিল করা হয়েছে। প্রার্থীতা বাতিল হওয়া অপর দুই স্বতন্ত্র প্রার্থী হলেন, অলিউর রহমান এবং আবুল হোসেন।
রিটার্নিং কর্মকর্তা জানান, স্বতন্ত্র প্রার্থী অলিউর রহমান তাঁর মনোনয়নের সঙ্গে শর্ত অনুযায়ী ৩০০ জন ভোটারের স্বাক্ষর যথাযথভাবে দাখিল করতে না পারায় তাঁর মনোনয়নও বাতিল করা হয়। আর অপর স্বতন্ত্র প্রার্থী আবুল হোসেন তার মনোনয়ন ফরম যথাযথভাবে পূরণ না করা এবং শর্ত অনুযায়ী ৩০০ জন ভোটারের স্বাক্ষর না থাকায় তার মনোনয়ন বাতিল করা হয়েছে।
রবিবার (৩০ এপ্রিল) বেলা ১১টায় গাজীপুর মহানগরীর বঙ্গতাজ অডিটরিয়ামে স্থাপিত গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে তিনি এ ঘোষণা দেন।
জাহাঙ্গীর আলমের মনোনয়ন ফরম বাছাইকালে রিটার্নিং কর্মকর্তা বলেন, জাহাঙ্গীর আলম মেয়র পদে এই নির্বাচনে যে সমস্ত কাগজপত্র দাখিল করেছেন, তার সবকিছু সঠিক পাওয়া গেছে। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের সিআইবি রিপোর্ট অনুযায়ী তিনি যে প্রতিষ্ঠানের জন্য জামিনদার হয়েছিলেন, সেই প্রতিষ্ঠানটি ঋণখেলাপি। জাহাঙ্গীর আলম উপস্থিত থাকলে আমরা তার কোন বক্তব্য থাকলে তা শুনতে চাই।
এ সময় উপস্থিত জাহাঙ্গীর আলম ও তার আইনজীবী রিটার্নিং কর্মকর্তার উদ্দেশে বলেন, উচ্চ আদালতের আদেশ অনুযায়ী জামিনদার কখনও ঋণখেলাপি হয় না। তাছাড়া খেলাপি ঋণগ্রহীতা প্রতিষ্ঠান ঋণ তফসিলিকরণের জন্য ইতোমধ্যে ডাউন পেমেন্টের টাকা জমা দেওয়া হয়েছে, ব্যাংক সেই টাকা বুঝে পেছে। ঋণটি পুন:তফসিলি করণের জন্য আবেদন করেছে।
এসময় জাহাঙ্গীর আলম আরো বলেন, শতভাগ রফতানি মূখী একটি কোরিয়ান শিল্প প্রতিষ্ঠানকে বাঁচানোর জন্য মানবিক কারণে আমার নিজের জমি বন্ধক রেখেছিলাম। আমি ওই টাকা নিজে নিইনি এবং প্রতিষ্ঠানটি ওই টাকা পরিশোধ করেছে।
এসময় সেখানে উপস্থিত ব্যাংকের কর্মকর্তা জানান, তিনি ডাউন পেমেন্টর টাকা জমা দিয়েছেন। আবেদন করেছেন। এর একটি প্রসিডিউর আছে। আজ ব্যাংকের বোর্ড সভা আছে। সেখানে বিষয়টি আলোচনার কথা রয়েছে। এসময় রিটার্নিং কর্মকর্তা তার কাছে জানতে চান, ঐ প্রতিষ্ঠান ঋণ খেলাপি নয়, এটা আপনি বলতে পারেন কি না। জবাবে তিনি বলেন, বোর্ড সভায় অনুমোদন হলে বলা যাবে।
এরপর রিটার্নিং কর্মকর্তা বলেন, ‘জাহাঙ্গীর আলম এই নির্বাচনে যে সমস্ত কাগজপত্র দাখিল করেছেন, তার সবকিছু সঠিক পাওয়া গেছে। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের সিআইবি রিপোর্ট অনুযায়ী তিনি যে প্রতিষ্ঠানের জন্য জামিনদার হয়েছিলেন, সেই প্রতিষ্ঠান ঋণখেলাপি হওয়ায় তাঁর মনোনয়ন বাতিল করা হলো।’
মনোনয়ন বাতিলের পর সেখানে জাহাঙ্গীর আলম তার মনোনয়ন বাতিল করাকে তিনি অগণতান্ত্রিক বলে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি বলেন, আমার সঙ্গে অবিচার করা হয়েছে। আমি কমিশনের কাছে নিরপেক্ষতা ও ন্যায়বিচার পাইনি। আমি এ ব্যাপারে উচ্চ আদালতে আপিল করবো।
জাহাঙ্গীর আলম আরও বলেন, ‘আমি কমিশনের কাছে নিরপেক্ষতা ও ন্যায়বিচার পাইনি। আমি এই আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করব, আমি হাইকোর্টে যাব, সুপ্রিম কোর্টে যাব।’
জাহাঙ্গীর আলম বলেন, আমি মনে করি এখানে নির্বাচন কমিশনারের যে নিরপেক্ষতাটা ছিল তা সে নিরপেক্ষতা থেকে সরে গেছে। কোন অদৃশ্য চাপে সরে গিয়েছে এটা আমি জানি। আমি ন্যায় বিচার চাই। আমি আপিল করবো, প্রয়োজনে সুপ্রিম কোর্ট, হাইকোর্টে যাবো। আমি সর্বশেষ লড়াই করে যাবো।
তিনি আরো বলেন, যেহেতু ব্যাংক টাকা পাবে, ব্যাংকে টাকা দেয়া হয়েছে কিন্তু সিআইবি নাম দিয়ে আমার নমিনেশন পত্র বাতিল করেছে। আমি ন্যায় বিচার চাই। আমি গাজীপুরের মানুষকে রক্ষা করতে চাই। সারা দেশবাসীর কাছে জানতে চাই। একজন প্রার্থী হিসেবে, একজন মানুষ হিসেবে, আমি ন্যায় বিচারটা পেতে পারি কিনা? সেজন্যে আমি সবার সহযোগিতা চাই। আমি চাই নির্বাচন কমিশনার তারা স্বচ্ছতার মধ্যে যেন কাজটা করে। আমি অবশ্যই আপিলে যাবো। আমি সর্বশেষ এটা দেখবো।
তিনি আরও বলেন, মিথ্যার জয় হয় না সত্যের জয় হয়। সত্যের জয়ের জন্য আমি লড়াই করছি। আমি সর্বশেষ পর্যন্ত দেখে যাবো। আমি রাষ্ট্র সরকার বিচার বিভাগ এবং নির্বাচন কমিশনারের পক্ষে নিরপেক্ষতা দৃষ্টি আকর্ষণ করছি আমি সবার সহযোগিতা চাই। আমাদের সিটি করপোরেশন সকল নাগরিকের মৌলিক অধিকার টুকু বাঁচানোর জন্য আমি চেষ্টা করছি। আমি সকলের সহযোগিতা কামনা করছি।
ব্যাংকের লোন পরিশোধ বিষয়ে তিনি বলেন, গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মধ্যে কোনাবাড়ি এলাকায় কোরিয়ান মালিকানাধীন নিউ টাউন নিট ওয়্যার কোম্পানী লি: (নেটিকেসি) নামে একটি কম্পোজিট কারখানা রয়েছে। ওই কোম্পানির মধ্যে আমার কোন শেয়ার নেই। কোন লভ্যাংশও নেই না। তবুও হাজার হাজার শ্রমিকদের বাঁচানোর জন্য মানবিক কারণে আমার নিজের সম্পদ দিয়েছি। ওই ব্যাংকের মর্টগেজ নিয়ে সেই কোরিয়ান মালিক লোন নিয়ে কারখানাটি চালু রেখেছে। করোনা মহামারীর কারণে কোরিয়ানরা ব্যাংকে যথাসময়ে ওই পেমেন্ট দিতে পারে নি। আমি প্রার্থী হওয়ার পর গত ১১এপ্রিল ও ১৮ এপ্রিল কোরিয়ানরা বাংলাদেশ ব্যাংক ও অগ্রণী ব্যাংকের যে পাওনা ছিল তা পরিশোধ করেছে। কোরিয়ান কোম্পনী ১৭ এপ্রিল অগ্রণী ব্যাংকের পাওনা টাকা পরিশোধ করেছে। সেই সমস্ত কাগজপত্র আইনজীবী এবং ব্যাংক কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে জমা দেয়া হয়েছে। তারপরও আমার মনোনয়ন বাতিল করা হয়েছে।
এদিকে বাছাইয়ে মনোনয়ন বৈধ হওয়ার পর সাংবাদিকদের কাছে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে নৌকার প্রার্থী, মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি এড. মো: আজমত উল্লা খান স্বস্তি প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, মনোনানয়ন বৈধ হওয়ায় আমি নির্বাচনকে কৃতজ্ঞতা জানাই। একই সাথে যারা এই নগরীকে পরিচ্ছন্ন জবাবদিহিমূলক এবং দুর্নীতিমুক্ত একটি কর্পোরেশন গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেছেন, দল মত নির্বিশেষে আমি তাদের সকলের কাছে আন্তরিক সহযোগিতা প্রত্যাশা করি। আমি আশা করি তারা সকলে ঐক্যবদ্ধভাবে ২৫ তারিখে নৌকাকে বিজয় করার জন্য কাজ করবেন।
এসময় তিনি দৃঢ়ভাবে আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, আমরা নৌকার পক্ষে গাজীপুর মহানগর আওয়ামীলীগ ও অঙ্গ সংগঠনের সকল নেতা কর্মী ঐক্যবদ্ধ রয়েছে। দল ১৪ দল এবং সাধারণ মানুষ যেহেতু আমার পক্ষে ঐক্যবদ্ধ রয়েছে সেজন্য আমি স্বস্তিবোধ করছি। ২৫ তারিখে নির্বাচনে নৌকার বিজয় হবে ইনশাআল্লাহ।
তার আলোচিত প্রতিপক্ষ জাহাঙ্গীর আলমের মনোনয়ন বাতিল হওয়ায় তিনি স্বস্তিবোধ করছেন কিনা জানতে চাইলে জবাবে তিনি বলেন, কেউ আমার প্রতিপক্ষ নয়, সকলেই আমরা প্রতিদ্বন্দ্বী। জাহাঙ্গীরের মনোনয়ন বাতিল নিশ্চয়ই স্বস্তিদায়ক।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটি একান্তই নির্বাচন কমিশনের বিষয়। আমি একজন প্রার্থী হিসেবে এ ব্যাপারে কোন মন্তব্য করতে চাই না। তবে, একজন আইনজীবী হিসেবে বলতে পারি, একজন আসামী আদালতের নিকট জামিন চাওয়ার পর তিনি বলতে পারেন না যে, তিনি জামিন পেয়েছেন। তিনি জামিন পাবেন কিনা সেটি আদালতের সিদ্ধান্তের বিষয়। একইভাবে একজন প্রার্থী বলেছেন, তিনি ঋণের তফসিলিকরণের জন্য টাকা জমা দিয়ে আবেদন করেছেন। কিন্তু সেটি এখনো অনুমোদন হয়নি। ব্যাংকের প্রতিনিধিও বলেছেন, আজকে ভোট মিটিং আছে। বোর্ড মিটিং এ বিষয়ে সিদ্ধান্তগ্রহণ করবে। সুতরাং এটি আমাদের কোন ব্যাপার না। এটা নির্বাচন কমিশনের বিষয়। নির্বাচন কমিশনের আইন রয়েছে, বিধি রয়েছে। সেই বিধির আলোকেই আমি মনে করি এটি সঠিক হয়েছে। যেহেতু বাংলাদেশ ব্যাংকের সিআইবি রিপোর্টে তিনি ঋণ খেলাপির জামিনদার। এ কারণে তার মনোনয়ন বাতিল করা রিটার্নিং কর্মকর্তার আইনানুক সিদ্ধান্ত। নির্বাচন কমিশন যা করেছে, সেটি আইন অনুযায়ী সঠিক হয়েছে। আইন সবার জন্য সমান। এতে কমিশনের নিরপেক্ষতা ক্ষুন্ন হয়নি বলেও তিনি মনে করেন।
আপিলে যদি জাহাঙ্গীর ফিরে আসেন তখন কি করবেন (?) জানতে চাইলে তিনি বলেন, আইন অনুযায়ী তিনি যদি ফিরে আসেন, আই মাস্ট ওয়েলকাম।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিএনপি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন বয়কট করেনি। কারণ সিটি কর্পোরেশন শুধু মেয়র দ্বারা পরিচালিত নয়। এখানে সংরক্ষিত নারী ও সাধারণ আসনের কাউন্সিলরগণ রয়েছেন। এটি একটি বডি দ্বারা পরিচালিত হয়। এখানে কাউন্সিলর পদে বিপুল সংখ্যক বিএনপি’র নেতাকর্মী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছেন। তাই বিএনপি সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ায়নি। শুধু মেয়র পদে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছে। তাই বিএনপি এই নির্বাচনের মাঠে রয়েছে।
মনোনয়নপত্র বাছাই অনুষ্ঠানে রিটার্নিং কর্মকর্তা ছাড়াও নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তা, বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাগণ এবং নির্বাচনে মনোনয়ন দাখিলকারী অন্যান্য মেয়র, কাউন্সিলর পদপ্রার্থীগণ উপস্থিত ছিলেন।