গণবাণী ডট কম:
গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী মেয়র, কাউন্সিলর ও সংরক্ষিত মহিলা আসনের মোট ৩৩৩ জন প্রার্থীর মধ্যে ২৯ দশমিক ৭৩ শতাংশ বিভিন্ন মামলার আসামি এবং ৪০ দশমিক ২৪ শতাংশ প্রার্থীর শিক্ষাগত যোগ্যতা এসএসসির নিচে।
সুশাসনের জন্য নাগরিক ( সুজন ) নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী প্রার্থীদের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য তুলে ধরতে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানানো হয়। সোমবার বেলা সাড়ে ১১টায় গাজীপুর প্রেসক্লাব মিলনায়তনে সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এতে এসব তথ্য তুলে ধরেন সংগঠনটির কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারী দিলীপ সরকার। প্রধান অতিথি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস।
সংবাদ সম্মেলনে সুজন জানায়, গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের ৮ জন মেয়র প্রার্থীর মধ্যে ২ জনের (২৫%) বিরুদ্ধে বর্তমানে মামলা আছে। এই দুইজন হলেন- জাতীয় পার্টির এমএম নিয়াজ উদ্দিন ও স্বতন্ত্র প্রার্থী সরকার শাহনূর ইসলাম। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রার্থী মো. আজমত উল্লা খানের বিরুদ্ধে অতীতে তিনটি মামলা ছিল, তবে বর্তমানে কোনো মামলা নেই। আজমত উল্লা খানের বিরুদ্ধে হওয়া মামলার মধ্যে একটি ৩০২ ধারার মামলাও ছিল।
সাধারণ ওয়ার্ড কাউন্সিলর পদের ২৪৬ জন প্রার্থীর মধ্যে ৮৪ জনের (৩৪ দশমিক ১৫%) বিরুদ্ধে বর্তমানে মামলা রয়েছে, ৪২ জনের (১৭ দশমিক ০৭%) বিরুদ্ধে অতীতে এবং ২৮ জনের (১১ দশমিক ৩৮) বিরুদ্ধে উভয় সময়ে মামলা ছিলো। প্রার্থীদের মধ্যে ৮ জনের বিরুদ্ধে (৩ দশমিক ২৫%) বর্তমানে ৩০২ ধারার মামলা রয়েছে, ৪ জনের বিরুদ্ধে অতীতে ৩০২ ধারার মামলা ছিল।
সংরক্ষিত আসনের ৭৯ জন প্রার্থীর মধ্যে ১৩ জনের (১৬ দশমিক ৪৬%) বিরুদ্ধে বর্তমানে ফৌজদারি মামলা আছে এবং ৩ জনের (৩ দশমিক ৮০%) বিরুদ্ধে অতীতে ফৌজদারি মামলা ছিলো। একজনের জনের বিরুদ্ধে বর্তমানে ৩০২ ধারার একটি মামলা রয়েছে, তিনি হলেন সংরক্ষিত ১ নং ওয়ার্ডের।
তারা বলছে, ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের তুলনায় এবারের নির্বাচনে মামলা সংশ্লিষ্ট প্রার্থীর সংখ্যা কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে, যা কোনোভাবেই ইতিবাচক নয়।
প্রার্থীদের শিক্ষাগত যোগ্যতার বিষয়ে তারা জানান, ৪০ দশমিক ২৪ শতাংশ প্রার্থীর শিক্ষাগত যোগ্যতা এসএসসির নিচে। তাদের মধ্যে ৮ জন মেয়র প্রার্থীর মধ্যে ৫ জনের (৬২ দশমিক ৫০%) শিক্ষাগত যোগ্যতা স্নাতকোত্তর, ১ জনের (১২ দশমিক ৫০%) শিক্ষাগত যোগ্যতা এসএসসি এবং ২ জনের (২৫%) শিক্ষাগত যোগ্যতা এসএসসির নিচে। স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী জায়েদা খাতুন নিজের শিক্ষাগত যোগ্যতা উল্লেখ করেছেন স্বশিক্ষিত এবং জাকের পার্টির মেয়র প্রার্থী মো. রাজু আহাম্মেদ ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন বলে উল্লেখ করেছেন। স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারীদের মধ্যে রয়েছেন, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রার্থী মো. আজমত উল্লা খান (এলএলএম), জাতীয় পার্টি প্রার্থী এম এম নিয়াজ উদ্দিন (এমএসএস), ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী গাজী আতাউর রহমান (তাকমিল), স্বতন্ত্র প্রার্থী সরকার শাহনূর ইসলাম (এমবিএ) ও মো. হারুন-অর-রশীদ (এমএ)।গণফ্রন্টের আতিকূল ইসলামের শিক্ষাগত যোগ্যতা এসএসসি উল্লেখ করেছেন ।
মোট ৫৭ টি সাধারণ ওয়ার্ডের ২৪৬ জন সাধারণ ওয়ার্ড কাউন্সিলর প্রার্থীর মধ্যে ৯২ জনের (৩৭ দশমিক ৪০%) শিক্ষাগত যোগ্যতা এসএসসি’র নিচে, ৩৯ জনের (১৫ দশমিক ৮৫%) এসএসসি এবং ৪৩ জনের (১৭ দশমিক ৪৮%) এইচএসসি। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রীধারী প্রার্থীর সংখ্যা যথাক্রমে ৫০ জন (২০ দশমিক ৩৩%) ও ২১ জন (৮ দশমিক ৫৪%)। ১ জন (শুন্য দশমিক ৪১%) সাধারণ ওয়ার্ড কাউন্সিলর প্রার্থী শিক্ষাগত যোগ্যতার ঘর পূরণ করেননি।
মোট ১৯টি সংরক্ষিত ওয়ার্ডের ৭৯ জন কাউন্সিলর প্রার্থীর মধ্যে প্রায় অর্ধেকের শিক্ষাগত যোগ্যতা এসএসসির নিচে ৪০ জন (৫০ দশমিক ৩৩%)। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী প্রার্থীর সংখ্যা যথাক্রমে ১২ জন (১৫ দশমিক ১৯%) ও ৮ জন (১০ দশমিক ১৩%)। অন্যদিকে এসএসসি ও এইচএসসি পাস প্রার্থীর সংখ্যা যথাক্রমে ১০ জন (১২ দশমিক ৬৬%) ও ৯ জন (১১ দশমিক ৩৯%)।
বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, সর্বমোট ৩৩৩ জন প্রার্থীর মধ্যে অর্ধেকের বেশি প্রার্থীর (১৮৪ জন বা ৫৫ দশমিক ২৬%) শিক্ষাগত যোগ্যতা এসএসসি ও তার নিচে, এর মধ্যে ১৩৪ জন (৪০ দশমিক ২৪%) প্রার্থী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের গণ্ডি অতিক্রম করেননি। পক্ষান্তরে স্নাতক বা স্নাতকোত্তর ডিগ্রীধারী প্রার্থীর সংখ্যা মাত্র ৯৬ জন (২৮ দশমিক ৮৩%)।
২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের সঙ্গে তুলনা করে দেখা যায়, ২০১৮ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে স্বল্পশিক্ষিত প্রার্থীর হার কিছুটা কমেছে। ২০১৮ সালে এসএসসি ও তার নিচে ছিল ৬০ দশমিক ৮৬%, যা এবার ৫৫ দশমিক ২৬%। অপরদিকে উচ্চ শিক্ষিত (স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রীধারী) প্রার্থীর হার বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৮ সালের ২৪ দশমিক ০৫% থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২০২৩ সালে হয়েছে ২৮ দশমিক ৮৩%। স্বল্পশিক্ষিত প্রার্থীর হার হ্রাস পাওয়া এবং উচ্চ শিক্ষিত প্রার্থীর হার বৃদ্ধি পাওয়া নিঃসন্দেহে ইতিবাচক।
প্রার্থীদের পেশা সংক্রান্ত তথ্য জানানো হয়, ৮ জন মেয়র প্রার্থীর মধ্যে ৩ জন (৩৭ দশমিক ৫০%) ব্যবসায়ী, ২ জন (২৫%) চাকুরিজীবী এবং ১ জন (১২ দশমিক ৫০%) আইনজীবী এবং ১ জন (১২ দশমিক ৫০%) গৃহ সম্পত্তি ভাড়া থেকে আয় করেন এবং ১ জন (১২ দশমিক ৫০%) অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা। ব্যবসার সাথে যুক্ত ৩ জন প্রার্থী হলেন জাকের পার্টির মেয়র প্রার্থী মোঃ রাজু আহাম্মেদ, জাতীয় পার্টির প্রার্থী এম এম নিয়াজ উদ্দিন এবং স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী জায়েদা খাতুন। চাকুরিজীবী ২ জন প্রার্থীর মধ্যে গণফ্রন্টের আতিকুল ইসলাম সাংবাদিকতা এবং ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী গাজী আতাউর রহমান শিক্ষকতার সঙ্গে যুক্ত। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রার্থী মোঃ আজমত উল্লা খান একজন আইনজীবী। স্বতন্ত্র প্রার্থী সরকার শাহনূর ইসলাম গৃহ সম্পত্তির ভাড়া থেকে আয় করেন এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী মোঃ হারুন-অর-রশীদ একজন পেনশনভোগী সরকারি কর্মকর্তা।
সাধারণ ওয়ার্ড কাউন্সিলর পদের ২৪৬ জন প্রার্থীর মধ্যে সিংহভাগ (১৯২ জন বা ৭৮ দশমিক ০৫%) প্রার্থীর পেশাই ব্যবসা। কৃষির সাথে সম্পৃক্ত আছেন ১৩ জন (৫ দশমিক ২৮%) করে। আইনজীবি রয়েছেন ৭ জন (২ দশমিক ৮৫%)। চাকুরিজীবী আছেন ১১ জন (৪ দশমিক ৪৭%)। ১৬ জন (৬ দশমিক ৫০%) প্রার্থী অন্যান্য পেশার সঙ্গে যুক্ত আছেন। ৭ জন (২ দশমিক ৮৫%) প্রার্থী পেশার ঘর পূরণ করেননি।
৭৯ জন সংরক্ষিত আসনের কাউন্সিলর প্রার্থীর মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য অংশই (৩৯ জন বা ৪৯ দশমিক ৩৭%) গৃহিণী। ১২ জন (১৫ দশমিক ১৯%) ব্যবসার সাথে যুক্ত। আইনজীবী রয়েছেন ৬ জন (৫৭ দশমিক ৫৯%)। চাকুরিজীবী রয়েছেন ৭ জন (৮ দশমিক ৮৬%)। অন্যান্য পেশার সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন ৭ জন (৮ দশমিক ৮৬%)। ৭৯ জন সংরক্ষিত আসনের কাউন্সিলর প্রার্থীর মধ্যে ৭ জন (৮ দশমিক ৮৬%) পেশার ঘর পূরণ করেননি।
তিনটি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী সর্বমোট ৩৩৩ জন প্রার্থীর মধ্যে অর্ধেকের বেশি প্রার্থী (২০৭ জন বা ৬২.১৬%) ব্যবসায়ী। বিশ্লেষণে অন্যান্য নির্বাচনের মত গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনেও ব্যবসায়ীদের প্রাধান্য লক্ষ করা যাচ্ছে।
এছাড়াও সুজন থেকে প্রার্থী ও নির্ভরশীলদের বাৎসরিক আয় সংক্রান্ত ও সম্পদের তথ্য, দায় দেনা সংক্রান্ত এবং আয়কর সংক্রান্ত তথ্য উপস্থাপন করা হয়।
তথ্য উপস্থাপন শেষে বক্তব্য রাখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণসংযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রুবায়েত ফেরদৌস, সুজনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারী দিলিপ কুমার, ঢাকা বিভাগের সমন্বয়ক তৌফিক জিল্লুর রহমান।
এসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন অবাধ সুষ্ঠু নিরপেক্ষ হয়তো হবে কিন্তু গ্রহণযোগ্যতার ক্ষেত্রে ঝাঁকুনি খেয়েছে। একটা বড় রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশ না নেওয়ায় এমনটি হয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেছেন।
অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস আরো বলেন, একজন প্রার্থীর কি যোগ্যতা তার পুরোপুরি তথ্য একজন ভোটারের জানা উচিত। এক্ষেত্রে একজন ভোটার প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে উপযুক্ততা নির্ণয় করতে পারেন। নির্বাচিত হওয়ার পর নির্বাচিত ব্যক্তিকে অবশ্যই তার জবাবদিহিতা যোগ্যতা স্বচ্ছতা এবং জন অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হয়। সেসব বিষয় নির্ণয়ের ক্ষেত্রেও ভোটারকে প্রার্থীর তথ্য জানতে হবে। প্রার্থীর মধ্যে জবাবদিহিতা আছে স্বচ্ছতা আছে কিন্তু সার্ভিস ডেলিভারি দেওয়ার মতো যোগ্যতা নেই। সেসব বিষয়গুলোর ব্যাপারে ও প্রার্থী নির্বাচনের ক্ষেত্রে ভোটার প্রার্থীর তথ্য কাজে লাগাতে পারবেন।
সুজনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারী দিলীপ সরকার বলেন, নির্বাহী বিভাগের দায়িত্ব হচ্ছে নির্বাচন সংশ্লিষ্টদের সহযোগিতা করা। নির্বাচন কমিশন এক্ষেত্রে মূল ভূমিকা পালন করবে। অতীতেও নির্বাচনের ব্যাপারে অনিয়মের অভিযোগ এসেছে। কেউ প্রচারণায় বাধা সৃষ্টি করছে এমন ঘটনা আমরা দেখতে চাই না। নির্বাচন কমিশনকে সাংবিধানিক দায়িত্ব দেয়া হয়েছে নির্বাহী বিভাগকে কাজে লাগানোর জন্য। প্রয়োজনে তিনি নির্বাহী বিভাগের লোকদেরকে বাধ্য করতে পারেন।
সুজনের জেলা কমিটির সভাপতি অধ্যাপক আমজাদ হোসেনের সভাপতিতে সম্মেলনে বিভিন্ন শ্রেণী পেশার প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।