গণবাণী ডট কম:
সংগ্রাম, ঐতিহ্য ও উন্নয়নের গৌরবময় অগ্রযাত্রাকে অব্যাহত রাখার দৃঢ় প্রত্যয়ে উপমহাদেশের প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের দুই দিনব্যাপী ২১তম জাতীয় সম্মেলন আজ শুক্রবার শুরু হচ্ছে। বিকাল ৩টায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বেলুন ও শান্তির প্রতীক পায়রা উড়িয়ে বর্ণাঢ্য সম্মেলনের উদ্বোধন করবেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী, প্রধানমন্ত্রী ও বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা।
এবারের জাতীয় কাউন্সিলে আওয়ামী লীগের স্লোগান হচ্ছে, ‘শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন পূরণে গড়তে সোনার দেশ, এগিয়ে চলেছি দুর্বার, আমরাই তো বাংলাদেশ’।
সম্মেলনকে কেন্দ্র করে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানকে বর্ণিল সাজে সাজানো হয়েছে। পোস্টার, ব্যানার, ফেস্টুন, তোরণ, আলোকসজ্জায় ঝলমল করছে পুরো সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। সম্মেলনে সারাদেশ থেকে সাড়ে ৭ হাজার কাউন্সিলর এবং ১৫ হাজার ডেলিগেটসহ ৫০ হাজার নেতাকর্মী ও আমন্ত্রিত অতিথি অংশ নেবেন। উদ্বোধনের পর ২৫ মিনিটের সংগীত পরিবেশন করা হবে। এতে তুলে ধরা হবে আওয়ামী লীগের ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং সরকারের উন্নয়ন ও সাফল্য।
মহান মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দলের সম্মেলনকে ঘিরে সারাদেশেই দলটির মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়েছে। নেতাকর্মীদের মধ্যে বিরাজ করছে উৎসবের আমেজ।
সম্মেলনের কাউন্সিল অধিবেশন আগামীকাল শনিবার সকাল ১০টায় রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে অনুষ্ঠিত হবে। এ অধিবেশনেই আগামী তিন বছরের জন্য দলের নতুন নেতৃত্ব ঘোষণা করা হবে। দলের নেতৃত্ব নির্বাচনের জন্য তিন সদস্যের নির্বাচন কমিশনের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পেয়েছেন দলের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন। অপর দুই সদস্য হলেন দলের উপদেষ্টা ড. সাইদুর রহমান ও ড. মশিউর রহমান। নির্বাচন কমিশন প্রথমে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে প্রার্থী আহ্বান করবেন। একাধিক প্রার্থী না থাকলে প্রস্তাব ও সমর্থনের মাধ্যমে শীর্ষ দুই নেতৃত্ব নির্বাচন করা হবে। এরপর কাউন্সিলরদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পরে দলের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করবেন নবনির্বাচিত সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক।
টানা ৯ম বারের মতো বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সভাপতি নির্বাচিত হতে যাচ্ছেন ৩৮ বছর ধরে দলটির নেতৃত্বদানকারী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা-এটা নিশ্চিত। তবে সবারই দৃষ্টি সাধারণ সম্পাদক পদটির দিকে। কে হচ্ছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক? ওবায়দুল কাদেরই বহাল থাকছেন, নাকি চমক দেওয়ার মতো অন্য কেউ এ নিয়ে দলটির ভিতরে ও বাইরে গুঞ্জন-আলোচনা এখন তুঙ্গে। তবে অনেকের মধ্যে পদ হারানোর শঙ্কাও রয়েছে।
এদিকে কোনো পদে একাধিক প্রার্থী থাকলে ভোট হবে এবং ভোটের জন্য স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স এবং ব্যালট পেপারও সংগ্রহ করা হয়েছে। আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী একাধিক নেতা জানান, সাধারণত কাউন্সিলররা নেতৃত্ব নির্বাচনের ক্ষমতা বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার ওপর অর্পণ করেন। এক্ষেত্রে সাধারণত সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে একক প্রার্থীর নাম ঘোষণা করা হয় এবং কাউন্সিলররা তা একবাক্যে সমর্থন করেন। সভাপতির ওপর পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের দায়িত্ব দেন কাউন্সিলররা। এবারও একই পদ্ধতিতে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে নেতা নির্বাচন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা জানিয়েছেন।
জানা গেছে, এবার সম্মেলনে গঠনতন্ত্রে মৌলিক কোনো পরিবর্তন আসছে না। তবে গঠনতন্ত্র সংশোধনের মাধ্যমে আকার বাড়ছে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের। ৪১ সদস্য থেকে বাড়িয়ে ৫১ করা হচ্ছে। বিলুপ্ত করা হচ্ছে দলের সহসম্পাদক পদ। একইভাবে মত্স্যজীবী লীগকে দলের সহযোগী সংগঠনের মর্যাদা দেওয়া হতে পারে। এদিকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরকারের অর্জনগুলো ঘোষণাপত্রে যুক্ত করা হয়েছে। ঘোষণাপত্রে নতুন সংযোজন- বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদ্যাপন।
এদিকে কারা নতুন নেতা হচ্ছেন, পুরোনো কে কে বাদ পড়ছেন, সে বিষয়ে এখনো সবাই অন্ধকারে। এ জন্য পদপ্রত্যাশী ও কেন্দ্রীয় কমিটিতে থাকা নেতারা উত্কণ্ঠায় রয়েছেন। অনেকেই ভুগছেন পদ হারানোর আতঙ্কে। আবার অনেকে রয়েছেন পদোন্নতির আশায়।
নৌকার আদলে সম্মেলন মঞ্চ :
আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলনের মূল মঞ্চ ১০২ ফুট দীর্ঘ, ৪০ ফুট প্রশস্ত মঞ্চে অনুষ্ঠিত হয়েছে চার সহযোগী এবং ঢাকা মহানগর উত্তর-দক্ষিণের সম্মেলন। সেই একই মঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে আওয়ামী লীগের ২১তম জাতীয় সম্মেলন। তবে মূল মঞ্চ এক হলেও সেটাকে বিশেষ পরিকল্পনায় সাজানো হয়েছে। আওয়ামী লীগের সম্মেলনের উদ্বোধীন অনুষ্ঠানে মঞ্চ তৈরি করা হয়েছে নৌকার আদলে। পদ্মাসেতুর সামনের বিশাল জলরাশিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে ছোটো ছোটো নৌকা। একপাশে চরে জেগে আছে কাশবন। এমনই একটি আবহের মধ্যে দাঁড়িয়ে বিশালাকার এক পালতোলা নৌকা। আছে জাতীয় স্মৃতিসৌধের প্রতিকৃতি। মূল মঞ্চের পেছনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার ছবি ছাড়াও ঠাঁই পেয়েছে জাতীয় চার নেতা—তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন এম এ মনসুর আলী এবং এ এইচ এম কামারুজ্জামানের ছবি। এছাড়া আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে অন্যতম চার নেতা—মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, শামসুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশের ছবি রাখা হয়েছে সেখানে।
২০২০ থেকে ২০২১ সালের মার্চ পর্যন্ত পালিত হবে মুজিববর্ষ। দেশে-বিদেশে মুজিববর্ষের জাঁকজমক ও বর্ণিল আয়োজন সামনে রেখে গত সম্মেলনের তুলনায় এবার সাদামাটা সাজসজ্জার মধ্য দিয়ে সম্মেলন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলটি। কেবল সম্মেলনস্থল সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে থাকছে নজরকাড়া সাজসজ্জা ও আলোর ঝলকানি। সম্মেলনস্থলে নেতাকর্মীদের প্রবেশের জন্য সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে পাঁচটি গেট থাকবে। একটি গেট ভিআইপিদের জন্য সংরক্ষিত থাকবে। জাতীয় ও কার্যনির্বাহী কমিটির ৮১ সদস্যের মধ্যে চারটি পদ শূন্য থাকায় মূল মঞ্চে চেয়ার থাকবে ৭৭টি। ২৮টি এলইডি পর্দায় দেখানো হবে সম্মেলনের পুরো অনুষ্ঠান। বাংলাদেশে নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের কূটনীতিক, দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা, শিক্ষক, চিকিত্সক, আইনজীবীসহ অন্য পেশার বিশিষ্টজনদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সংলাপে অংশ নেওয়া সব দেশের সব রাজনৈতিক দলকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। ওয়েবপেজের ভিডিও অংশে সম্মেলন লাইভ করা হবে।
সম্মেলনস্থলে নেতাকর্মীদের প্রবেশের জন্য সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে পাঁচটি গেট থাকবে। একটি গেট ভিআইপিদের জন্য সংরক্ষিত থাকবে। ৮১ সদস্যের মধ্যে চারটি পদ শূন্য থাকায় মূল মঞ্চে চেয়ার থাকবে ৭৭টি। মঞ্চের সামনে নেতাকর্মীদের জন্য চেয়ার থাকবে ৩০ হাজার। এছাড়া সম্প্রসারিত মঞ্চে ১৫ হাজার চেয়ার দেয়া হবে। ২৮টি এলইডি পর্দায় দেখানো হবে সম্মেলনের পুরো অনুষ্ঠান।
অন্যদিকে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি মাথায় রেখে আওয়ামী লীগের ২১তম জাতীয় সম্মেলনকে নির্বিঘ্ন করতে ঢেলে সাজানো হয়েছে নিরাপত্তা ব্যবস্থা। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকবেন আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতীম সংগঠনের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত স্বেচ্ছাসেবকরা।
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় করে সম্মেলনস্থল, প্রবেশপথসহ চারপাশে দলীয় স্বেচ্ছাসেবকরা কাজ করবেন বলে জানিয়েছেন সম্মেলনের শৃঙ্খলা ও স্বেচ্ছাসেবক বিষয়ক উপ-কমিটির সদস্য সচিব আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম।
১৯৪৯ থেকে ২০১৯
১৯৪৯ সালের ২৩ জুন রোজ গার্ডেনে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’ নামে। ১৯৫৬ সালে ময়মনসিংহে অনুষ্ঠিত দলীয় কাউন্সিলে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ’ নামকরণের মাধ্যমে দলটি অসাম্প্রদায়িক বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর নামকরণ হয় ‘বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ’। এখন দলটি প্রতিষ্ঠার ৭০ বছর পার করছে। এ পর্যন্ত দলের ২০টি জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। ১৯৪৯ সালে ২৩ ও ২৪ জুন পুরান ঢাকার কে এম দাস লেনের ঐতিহাসিক রোজ গার্ডেনে আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাকালীন সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। আতাউর রহমান খানের সভাপতিত্বে প্রথম জাতীয় সম্মেলনে প্রতিনিধি ছিলেন প্রায় ৩০০ জন। উদ্বোধনী ভাষণ দেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। পরে প্রতিনিধিদের সমর্থনে ৪০ সদস্যের কমিটি ঘোষণা করা হয়। এই সম্মেলনে সভাপতি নির্বাচিত হন মওলানা ভাসানী, সাধারণ সম্পাদক হন শামসুল হক। তখন তরুণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন কারাগারে বন্দি। বন্দি অবস্থায় তাকে সর্বসম্মতিক্রমে প্রথম কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়। ১৯৫৩ সালে ৩, ৪ ও ৫ জুলাই ঢাকার মুকুল সিনেমা হলে দলের দ্বিতীয় কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। এতে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী সভাপতি এবং শেখ মুজিবুর রহমান সাধারণ সম্পাদক হন। এর আগে দুই দিনব্যাপী বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ২০তম জাতীয় সম্মেলন ২০১৬ সালের ২২ ও ২৩ অক্টোবর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে শেখ হাসিনা সভাপতি ও ওবায়দুল কাদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
২১তম জাতীয় সম্মেলন প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, আওয়ামী লীগ একটি পরিবার। আমাদের অবিভাবক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আমাদের কাজে-কর্মে এবং ব্যবহারের মাধ্যমে প্রমাণ করতে হবে আওয়ামী লীগ একটি সুসংগঠিত দল। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নতুন ও পুরনোদের নিয়ে দলের আগামী কমিটি হবে আধুনিক ও সুসংগঠিত। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বুকে ধারণ করে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। আওয়ামী লীগের ২১তম জাতীয় সম্মেলনের সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন জানিয়ে তিনি বলেন, এবারের সম্মেলন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই দলে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা ছাড়া অন্য কেউ অপরিহার্য নয়।