বিশেষ প্রতিবেদন :
কাপাসিয়া ডিগ্রি কলেজে আসন্ন এইচএসসি পরীক্ষার ফরম পূরণে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ওয়াজেদুর রহমানের বিরুদ্ধে নানা অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে নির্বাচনী পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়ে ফরম পূরণের সুযোগ বঞ্চিত বিপুল সংখ্যক বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থী গত বৃহস্পতিবার অধ্যক্ষের অফিস কক্ষ ঘেরাও করে তাকে প্রায় দুই ঘন্টা অবরুদ্ধ করে রাখে এবং ভাংচুর চালায়। এ ঘটনার পর উদ্ভুত পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা ও করণীয় বিষয়ে আলোচনার জন্য শুক্রবার সন্ধ্যায় কলেজ পরিচালনা কমিটির সভাপতি ও গাজীপুরের জেলা প্রশাসক এস এম তরিকুল ইসলাম তার কার্যালয়ে জরুরী সভা আহবান করেছেন।
সংশ্লিষ্টরা জানায়, গাজীপুরের কাপাসিয়া ডিগ্রি কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের নানা অনিয়ম, দুর্ণীতি ও স্বেচ্চাচারিতার কারণে ডুবতে বসেছে কলেজটি। গত এক দশকে কলেজের পরিচালনা পরিষদ, কলেজের অধ্যক্ষের দুর্ণীতির কারণে কলেজের আয় হ্রাস পাওয়ার পাশাপাশি কমেছে শিক্ষার মান ও শিক্ষার্থী। নানা অনিয়ম, দুর্ণীতি প্রমানিত হলেও বিদায়ী অধ্যক্ষ ও বর্তমান ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় কলেজে কোন শৃংখলা আসছে না।
বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, বিগত সময়ে কলেজ পরিচালনা পরিষদ ও বিদায়ী অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে অনিয়ম, দুর্ণীতির নানা অভিযোগ ছিল। জাতীয় বিশ্ব বিদ্যালয়ের নির্দেশে কলেজ পরিচালনা পরিষদ ভেঙ্গে দিয়ে গাজীপুরের জেলা প্রশাসককে সভাপতি করে এডহক কমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটি রহস্যজনক কারণে তৎকালীন অধ্যক্ষ ছানাউল্লার বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম, দুর্ণীতি প্রমানিত হলেও কোন ব্যবস্থা নেয়নি। তিনি নানা অনিয়ম, দুর্ণীতি করেও নিরাপদে অবসরে চলে যান। পরে জৈষ্ঠতা লংঘন করে কলেজের অধ্যাপক মোঃ ওয়াজেদুর রহমানকে কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসাবে নিয়োগ দেয়া হয়। নিয়োগ পাওয়ার পর ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ বিপুল উৎসাহ নিয়ে বিদায়ী অধ্যক্ষের পথ অনুসরণ করতে থাকেন। তাঁর বিরুদ্ধে গত বছর বিভিন্ন পরীক্ষার ফরম পুরণে অনিয়ম ও দুণীতির অভিযোগ তদন্তে প্রমানিত হয়। কলেজ পরিচালনা কমিটির সভায় ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ দুর্ণীতির কথা প্রকাশ্যে স্বীকার করেন। এছাড়া তার বিরুদ্ধে কাপাসিয়া কলেজের চেয়ে শিক্ষর মানে পিছিয়ে থাকা কলেজ থেকে টিসি প্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের অনিয়মের মাধ্যমে কলেজে ভর্তি করার অভিযোগ রয়েছে। তিনি অধ্যক্ষ নিয়োগ বিলম্বিত করার লক্ষে কলেজ পরিচালনা কমিটিকে বিভ্রান্ত করার কারণে সকল প্রক্রিয়া শেষে অধ্যক্ষ বাছাই সম্পন্ন করেও নিয়োগ অনুমোদন করেনি শিক্ষ বোর্ড। পরে গেল বছর পুনরায় অধ্যক্ষ নিয়োগের বিজ্ঞাপনেও শুধু জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধি মোতাবেক দরখাস্ত আহবান করা হয়। এখানে এমপিও নীতিমালা উল্লেখ না করায় আবারও নিয়োগ চুড়ান্ত করলে জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে। আর অধ্যক্ষ নিয়োগ যতদিন দেরি হবে ততদিন তাঁর দুর্ণীতির চাকা চলতে থাকবে। গাজীপুর জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে গঠিত তদন্ত কমিটির তদন্তেও অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেলেও তাঁর বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
সর্বশেষ, উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষয় ফরম পুরণে নানা অনিয়মের অভিযোগে ফরম পুরণে ব্যর্থ শিক্ষার্থীরা গত বৃহস্পতিবার কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষকে দুই ঘন্টার অধিক অফিস কক্ষে অবরুদ্ধ করে রাখে। পরে সন্ধ্যায় ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মোঃ ওয়াজেদুর রহমান তাদের ফরম পুরণের আশ্বাস দিলে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন শিথিল করে।
জানা যায়, বোর্ডের সার্কুলার অনুযায়ী কয়েক দফা সময় বাড়ানোর পর বিলম্ব ফি ছাড়া ফরম পুরণের সর্বশেষ সময় ছিল ২৯ ডিসেম্বর ২০১৯ এবং বিলম্ব ফিসহ ফরম পুরণের সময় ৫ জানুয়ারী ২০২০ শেষ হয়েছে। এবার কলেজে ফরম পুরণে দুর্ণীতি রোধ করতে কলেজ পরিচালনা কমিটির সভাপতি ও গাজীপুরের জেলা প্রশাসক ফরম পুরণের কাজ তদারক করতে মানবিক, বাণিজ্য ও বিজ্ঞান বিভাগের জন্য ৩টি আলাদা কমিটি করে দেন।
কলেজ সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরে কাপাসিয়া ডিগ্রি কলেজে তিন বিভাগে নিয়মিত ৩৪৬ জন ও অনিয়মিত ১০০ জন এইচএসসি পরীক্ষার্থী রয়েছে। কলেজে নির্বাচনী পরীক্ষায় নিয়মিতদের মাঝে কৃতকার্য হয়েছে ২৩৮ জন। তারমধ্যে বিজ্ঞান বিভাগের ২০ জন, ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগের ৫৯ জন ও মানবিক বিভাগের ১৫৯ জন। এতে প্রায় অর্ধেক শিক্ষার্থী অকৃতকার্য হয়। চলতি বছরের ৫ জানুয়ারি শেষ তারিখ নির্ধারণ করে তিনটি কমিটি যথাসময়ে টেস্ট পরীক্ষায় উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের ফরম পুরনের কাজ সমাপ্ত করে।
পরে গত ১৫ জানুয়ারি ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ যে সব শিক্ষার্থীরা এক ও দুই বিষয়ে অকৃতকার্য হয়েছে, তারা পুনরায় পরীক্ষ দিয়ে ফরম পূরণ করার সুযোগ পাবে বলে নোটিশ জারি করেন। তাতে বলা হয়, ১৬ জানুযারি পুনরায় টেস্ট পরীক্ষ হবে। আগ্রহী শিক্ষার্থীরা নোটিশ পেয়ে পরীক্ষার প্রস্তুতি নিয়ে কলেজে এসে জানতে পারে, চার-পাঁচ বিষয়ে অকৃতকার্য হয়েছে এমন ২৩ জনের অধিক শিক্ষার্থী অধ্যক্ষকে ১১ হাজার বা তার বেশী টাকা দিয়ে অনেক আগেই ফরম পূরণ করার সুযোগ পেয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ওয়াজিদুর রহমান নির্বাচনী পরীক্ষায় দুই বা ততোধিক বিষয়ে অকৃতকার্য ২৩ জন শিক্ষার্থীকে নিয়ম বহির্ভূতভাবে ফরম পূরণের সুযোগ করে দিয়েছেন। যাদের মাঝে পাঁচ বিষয়ে অকৃতকার্য ১ জন, চার বিষয়ে অকৃতকার্য ২ জন, তিন বিষয়ে অকৃতকার্য ৮ জন, দুই বিষয়ে অকৃতকার্য ৯ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। এমনকি মানবিক বিভাগের একজন সকল বিষয়ে অকৃতকার্য ও বিজ্ঞান ও মানবিক বিভাগের দুই জন শিক্ষার্থী নির্বাচনী পরীক্ষায় অংশগ্রহণ না করেও ফরম পূরণের সুবিধা পেয়েছে। কিন্তু অন্য দিকে এক বা দুই বিষয়ে অকৃতকার্য হয়ে ফরম পূরণের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছে প্রায় ৮৫ জন নিয়মিত শিক্ষার্থী। ফরম পূরণে বঞ্চিত শিক্ষার্থীরা ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের এসব অনিয়মের সংবাদ পেয়ে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। একপর্যায়ে কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষকে অফিস কক্ষে অবরুদ্ধ করে রাখে। এ সময় তারা অধ্যক্ষের কক্ষ থেকে চেয়ার টেনেহিঁচড়ে বাহিরে ফেলে দেয় এবং ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের সাথে দীর্ঘ সময় তাদের কথা কাটাকাটি হয়। এ সময় উত্তেজিত শিক্ষার্থীরা “কাপাসিয়া কলেজ অধ্যক্ষের ঘুষবাণিজ্য বন্ধ করো”, “শিক্ষাঙ্গনে দুর্নীতি চলবে না, চলবে না” বলে শ্লোগান দিতে থাকে। এসময় ফরম পুরণে ব্যর্থ কয়েকজন শিক্ষার্থীকে কান্নায় ভেঙ্গে পড়তে দেখা যায়।
এ বিষয়ে কাপাসিয়া ডিগ্রি কলেজ শাখা ছাত্রলীগ সভাপতি মাহমুদুল হাসান মামুন জানান, ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ অনিয়মের মাধ্যমে ২৩ জনেরও অধিক শিক্ষার্থীকে ফরম পূরণ করতে দিয়েছেন। নিরীহ ৮৫ জন শিক্ষার্থীকে ফরম পূরণের সুযোগ দেননি। এতে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষকে অবরুদ্ধ করে রাখে এবং ভাংচুর চালায়। কলেজের গভর্নিং বডির সভাপতির মাধ্যমে ন্যায় বিচারের আশ্বাস দিয়ে পরিস্থিতি শান্ত করা হয়। এ বিষয়ে সভাপতির কাছে সুষ্ঠু বিচার দাবি করছি।
এসব বিষয়ে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ওয়াজেদুর রহমান ১৬ জানুয়ারি অবরুদ্ধ অবস্থা থেকে বের হয়ে স্থানীয় সাংবাদিকদের বলেছিলেন, আমার অজান্তে অকৃতকার্য শিক্ষার্থীদের ফরম পূরণ হয়ে থাকে এ জন্য আমি দুঃখিত। তবে ফরম পূরণে বঞ্চিত শিক্ষার্থীদের নিয়ম অনুযায়ী তাদের ফরম পূরণ করে পরীক্ষা দেয়ার ব্যবস্থা নিবো। তবে, পরে এসব বিষয়ে তার বক্তব্য নেয়ার জন্য যোগাযোগ করেও তিনি ব্যস্ত থাকায় তার বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।
কলেজের চলমান এসব অনিয়ম নিয়ে কথা বলার জন্য ১৭ জানুয়ারি রাত ৮টার দিকে কলেজ পরিচালনা পরিষদেও সভাপতি ও গাজীপুরের জেলা প্রশাসক এস এম তরিকুল ইসলামের সাথে যোগাযোগ করলে তিনি জানান, কলেজের বিষয়ে আলোচনার জন্য তারঁ কার্যালয়ে ইজতেমার ব্যস্ততার মধ্যেও জরুরী সভা ডাকা হয়েছে। সভা শেষে চলমান সমস্যা সমাধানে কি ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে জানানো হবে।