গণবাণী ডট কম:
বাংলাদেশের জেলাগুলোয় করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যার হিসেবে ঢাকা মহানগরীর পর এতদিন নারায়ণগঞ্জ জেলার অবস্থান হলেও এখন সেই স্থান নিয়েছে গাজীপুর।
গাজীপুরে কাপাসিয়া উপজেলার স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা এবং উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের নার্স, স্বাস্থ্যসহকারীসহ ১৭জন কর্মচারী ও তাদের স্বজন করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। গাজীপুরের কালীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ৫ চিকিৎসকসহ ১১ স্বাস্থ্যকর্মী করোনাভাইরাস পরীক্ষার ফলাফল পজিটিভ হয়েছে। এছাড়াও কালীগঞ্জ থানার এক উপ পুলিশ পরিদর্শক (এসআই) করোনা পজিটিভ হয়েছে। এসব ছাড়াও জেলার অন্যান্য এলাকা নিয়ে জেলায় ১১ চিকিৎসক এবং ৩৬জন স্বাস্থ্যকর্মী ও তাদের স্বজন, সাংবাদিক ও পুলিশ সদস্যসহ গাজীপুরে সর্বমোট ১৪৯ জনের দেহে করোনা ভাইরাস সনাক্ত হয়েছে। আক্রান্তরা সবাই আইসোলেশনে রয়েছেন।
অপরদিকে শনিবার নিয়মিত ব্রিফিংয়ে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইন্সটিটিউট আইইডিসিআর। প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক মীরজাদি সেব্রিনা ফ্লোরা বলেছেন, গত কয়েকদিনে গাজীপুরে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বেড়েছে। গাজীপুরে সংক্রমিত এই রোগীদের একটি বড় অংশ নারায়ণগঞ্জ থেকে গেছেন বলে তারা জানতে পেরেছেন।
এছাড়া ঢাকা বিভাগের মধ্যে নরসিংদী এবং কিশোরগঞ্জ জেলাতেও নতুন সংক্রমিত রোগীর সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে বলে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন। স্বাস্থ্য অধিদফতরের নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংয়ে মিজ ফ্লোরা বলেছেন, নতুন করে যতজন আক্রান্ত হয়েছেন তাদের মধ্যে ৩১% রোগীর অবস্থান ঢাকায়। এরপরেই রয়েছে গাজীপুর।
আইইডিসিআর এর ওয়েবসাইট থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, দেশজুড়ে সর্বমোট করোনাভাইরাস শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ২,১৪৪ জন। এদের মধ্যে ঢাকা বিভাগেই পাওয়া গেছে ১৩৭০ জন। এরমধ্যে, ঢাকা মহানগরীতে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছে ৭৪০ জনের মধ্যে, নারায়ণগঞ্জে ১৮৯ জনের মধ্যে এবং গাজীপুরে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৪৯ জনে।
গাজীপুরে আক্রান্তের এই সংখ্যা বেড়েছে বিগত কয়েকদিনে। গাজীপুরের সিভিল সার্জন অফিস সূত্রে জানা গেছে, গাজীপুরে প্রতিদিনই করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ পর্যায়ক্রমে বৃদ্ধি পাচ্ছে। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গত ১৩ এপ্রিল ১২জন, ১৪ এপ্রিল ১৬জন, ১৫ এপ্রিল ২৮জন, ১৬ এপ্রিল ৩১জন এবং ১৭ এপ্রিল ৩৭জন করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। আক্রান্তের সংখ্যার দিক দিয়ে কাপাসিয়া জেলার মধ্যে এগিয়ে রয়েছে। সেখানে মোট আক্রান্ত হয়েছে ৬২ জন।
গাজীপুর জেলা প্রশাসক এস এম তরিকুল ইসলাম শনিবার সকালে জানিয়েছেন, কাপাসিয়ার এ প্রেক্ষাপটে বেশী সংখ্যক মানুষের করোনা পরীক্ষার জন্য ঢাকা থেকে স্বাস্থ্য বিভাগের একটি বড় টিম কাপাসিয়া আসবে। এজন্য নীতিগত সিদ্ধান্ত চুড়ান্ত হয়েছে। তাদের উদ্দেশ্য হলো আরো বেশী সংখ্যক মানুষের পরীক্ষা করে কাপাসিয়ার প্রকৃত অবস্থা জানা। যাতে কাপাসিয়ায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা যায়।
গাজীপুরে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে থাকায় উদ্বেগের মধ্যে আছেন গাজীপুরের বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দাগণ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও গণমাধ্যমে নানাভাবে জানান দিচ্ছেন তাদের উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা।
প্রাণঘাতি করোনাভাইরাস বা কোভিড ১৯ এর সংক্রমণ ঠেকাতে গাজীপুর জেলাকে গত ১১ এপ্রিল লক ডাউন ঘোষণা করা হয়। ঐদিন সন্ধ্যায় গাজীপুর জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এস এম তরিকুল ইসলাম গাজীপুর জেলাকে অবরুদ্ধ (লকডাউন) ঘোষণা করে গণবিজ্ঞপ্তি জারি করেন।
গণ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, প্রাণঘাতি করোনাভাইরাস বা কোভিড ১৯ এর সংক্রমণ ঝুকি মোকাবেলায় ও জরুরী সুরক্ষার প্রয়োজনে দেশের অভ্যন্তরে করোনাভাইরাস প্রতিরোধ সংক্রান্ত জেলা কমিটির সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জেলায় জন সাধারণের প্রবেশ ও প্রস্থান নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে ১১ এপ্রিল ২০২০ থেকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত গাজীপুর জেলাকে অবরুদ্ধ (লক ডাউন) ঘোষণা করা হলো।
গণ বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, ভিন্ন জেলা হতে পাশবর্তী জেলায় গমণের উদ্দেশ্যে ট্রানজিট হিসেবে জাতীয় মহাসড়ক ব্যবহার ব্যতীত জেলা-উপজেলার যে কোন সীমানা দিয়ে প্রবেশ ও প্রস্থানে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হলো। নৌপথেও এ নিষেধাজ্ঞা বলবৎ থাকবে।
এতে আরো উল্লেখ করা হয়েছে, এই সময়ে সব ধরণের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, জমায়েত, গণপরিবহন এবং দিন রাতে জনসাধারণের চলাচল বন্ধ থাকবে। তবে জরুরী পরিষেবা, চিকিৎসা সেবা, কৃষিপণ্য ও খাদ্য দ্রব্য সরবরাহ, সংগ্রহ, উৎপাদন ও পরিবহন ইত্যাদি এর আওতা বহির্ভূত থাকবে।
কিন্তু মানুষকে ঘরে রাখা যাচ্ছে না। নানা অজুহাতে, বিনা প্রয়োজনে মানুষ জন ঘরে বাইরে বেরিয়ে আসছেন। বাজারে যাচ্ছেন, মোড়ের দোকানে আড্ডা দিচ্ছেন। জেলা প্রশাসন, জেলা ও মহানগর পুলিশ, র্যা ব, সেনা বাহিনীর সদস্যগণ বিরামহীণ কাজ করে যাচ্ছেন। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। জেলা প্রশাসক এস এম তরিকুল ইসলামের নির্দেশনায় সকল উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটগণ প্রতিদিন ঘরে ৭ থেকে ৮ টি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালিত হচ্ছে। বাইরে ঘুরাফেরা করায়, নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে দোকান খোলা রাখাসহ সামাজিক দুরত্ব বঝায় না রাখার অপরাধে সতর্ক করা হচ্ছে, শাস্তি ও দন্ড দেয়া হচ্ছে। গাজীপুর মহানগর পুলিশ কমিশনার মো: আনোয়ার হোসেন পিপিএম (বার) বিপিএম (বার) নিজে সরাসরি পুলিশের টহল ও চেকপোস্ট বসিয়ে লক ডাউন বাস্তবায়নে মহানগর এলাকায় কাজ করছেন। জেলা পুলিশ সুপার নিজে দিন রাত জেলার বিভিন্ন এলাকায় জেলার সকল অতিরিক্ত পুলিশ সুপারদের নিয়ে ঘুরে ঘুরে লক ডাউন বাস্তবায়নে বিরামহীনভাবে কাজ করছেন। মানুষ যাতে খাবারের জন্য বাইরে বেরিয়ে না আসে সে জন্য তারা সকলেই সাধ্যমত ত্রাণ পৌছে দিচ্ছেন অসহায় ও দরিদ্র কর্মহীন মানুষের ঘরে ঘরে।
মানুষের চলাচল বন্ধ হচ্ছেনা :
কিন্তু বেশিরভাগ মানুষের মধ্যে সচেতনতার অভাব রয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশের এআইজি (মিডিয়া) সোহেল রানা। অথচ করোনাভাইরাসের এই প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে ২৬শে মার্চ থেকে দেশব্যাপী কার্যত লকডাউন চলছে। এরপর ৫ই এপ্রিল থেকে শুধুমাত্র জরুরি প্রয়োজন ছাড়া ঢাকার ভেতরে প্রবেশ এবং বের হওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিলেন পুলিশের মহাপরিদর্শক। এছাড়া এক জেলা থেকে অন্য জেলা থেকে চলাচলেও দেয়া হয় কঠোর নিষেধাজ্ঞা। এসব নির্দেশনা বাস্তবায়নে পুলিশের পাশাপাশি সশস্ত্র বাহিনী অবস্থান নিলেও মানুষের চলাচল পুরোপুরি ঠেকানো যায়নি।
মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানোই বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে মনে করেন মি. রানা। তিনি বলেন, “জরুরি পণ্য ও জরুরি সেবার চলাচল অনুমোদিত হওয়ায় অনেকেই সেই অজুহাত দেখিয়ে চলাচল করছে। কেউ চিকিৎসার কথা বলছেন, আত্মীয়কে দেখতে কিংবা আত্মীয়কে নিয়ে হাসপাতালে যাওয়ার কথা বলছেন। কিন্তু বেশিরভাগই কোন প্রমাণ দেখাতে পারছেন না।”
আবার যারা নিজেদেরকে জরুরি সেবার সাথে নিজেদের জড়িত বলে দাবি করছেন, কিন্তু প্রমাণ দেখাতে পারছেন না, পুলিশ তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গেলে তারা গণমাধ্যমের কাছে সংশ্লিষ্ট পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন।
এ কারণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যেসব সদস্য মাঠ পর্যায়ে কাজ করেন তাদের জন্য বিষয়টি বেশ বিব্রতকর হয়ে পড়ে বলে তিনি জানান। মি. রানা বলেন, নিয়ম লঙ্ঘনকারী এই মানুষদের একটি বড় অংশই শিক্ষিত ও সচেতন শ্রেণীর মানুষ।
তিনি আরো বলেন, “মানুষ যদি নিজ থেকে বাড়িতে থাকার প্রয়োজনীয়তা অনুভব না করেন, আইনশৃঙ্খলাবাহিনীকে সহযোগিতা না করেন, তাহলে শুধু আইন দিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ বেশ কঠিন।”
সূত্র : বিবিসি ও অন্যান্য।