গণবাণী ডট কম:
গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন-২০২৩ : প্রত্যাশা ও করণীয় শীর্ষক নাগরিক সংলাপে অংশ নিয়ে নির্বাচনের অধিকাংশ মেয়র প্রার্থী সুষ্ঠ নির্বাচনের প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছেন। বুধবার সকালে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)গাজীপুর প্রেসক্লাবে নাগরিক সংলাপ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।
এই সংলাপে গাজীপুর সিটি নির্বাচনে মেয়র পদে অংশ নেওয়া ৯ প্রার্থীর মধ্যে ৭ মেয়র প্রার্থী অংশ নেন। অংশগহণকারী মেয়র প্রার্থীরা হলেন, আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়র প্রার্থী অ্যাডভোকেট আজমত উল্লাহ্ খান, বিএনপি পরিবারের স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী সরকার শাহানূর ইসলাম রনি, আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী আব্দুল্লাহ আল মামুন মন্ডল ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আতাউর রহমান, গণফ্রন্টের আতিকুল ইসলাম, স্বতন্ত্র প্রার্থী হারুন অর রশিদ ও রাজু আহমেদ। অংশ নেননি আলোচিত সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের মা জায়েদা খাতুন ও জাতীয় পার্টির প্রার্থী এম এম নিয়াজ উদ্দিন।
সংলাপে উপস্থিত নাগরিকরা বিগত ১০ বছরেও গাজীপুর সিটি করপোরেশন নাগরিকদের মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে না পাড়ায় সাধারণ ভোটার ও নাগরিক সমাজ উদ্বেগ প্রকাশ করেন। সংলাপে অংশ নিয়ে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ব্যতিত অন্য প্রার্থীরা নাগরিকদের বিভিন্ন প্রত্যাশার উত্তর দেয়ার পাশাপাশি নিজেরা সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রত্যাশা জানিয়ে কথা বলেছেন। তারা নির্বাচনকে অবাধ নিরপেক্ষ গ্রহণযোগ্য করার জন্য তাগিদ দেন। অন্য দিকে আওয়ামীলীগের প্রার্থী সিটি করর্পোরেশনে জনগণকে সংম্পক্ত করে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে চান। সুষ্ঠ ভোট অনুষ্ঠিত করতে ক্ষমতাশীন দলের প্রতি আহবান জানায় সুজনের কেন্দ্রীয় নেতারা।
সংলাপে অংশ নিয়ে গাজীপুর বিএম কলেজের সহকারী অধ্যাপক আসাদুজ্জামান আকাশ বলেন, নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কাজের সাথে যেসব পেশাজীবীরা ভোট গ্রহণের সঙ্গে সম্পৃক্ত তাদেরকে যেন কোন কিছুতে অনৈতিক কাজে বাধ্য করা না হয়। তাদের আইশৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক অথবা কোন না কোনো অদৃশ্য চাপে যেন তাঁর দায়িত্বটা অনৈতিকভাবে পালনের জন্য বাধ্য করা না হয়।
গাজীপুর ইমাম সমিতির সাধারণ সম্পাদক মাওলানা আবু বকর বলেন, ইমামরা যেন মসজিদে সুষ্ঠু সমাজ ব্যবস্থা গড়ার জন্য তারা আলোচনা করতে পারে সেই নিশ্চয়তা চান। সিটি কর্পোরেশন যেন ইমামদের প্রতি দায়িত্ববান হোন।
গাজীপুর বেসরকারী হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার সমিতির সভাপতি আব্দুস সালাম বলেন, আমাদের এ নগরীর হাসপাতালের বর্জ্য ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মাধ্যমে ফেলা হয়। মেডিকেল বর্জ্য অপসারনের বিষয়টি আমাদের গাজীপুরেই যেন অপসারণ করতে পারি সে ব্যবস্থা করতে হবে।
গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সহ-সভাপতি জিয়াউল কবির বলেন, শ্রমিকরাই সিটির বৃহৎ অংশ। নিম্ন আয়ের পোশাক শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নে শ্রমিকদের জন্য শ্রমিক হাসপাতাল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বেতন নিয়ে তাদের নির্বিগ্নে ঘরে ফেরার নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে বাস্তমুখী উদ্যোগ ও প্রকল্প গ্রহনের দাবি জনান।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, টঙ্গী সাংগঠনিক শাখার সভাপতি আনোয়ারা বেগম নারী অধিকার, হয়রানী মুক্ত, তড়িৎসেবা নিশ্চিতকরণে সিটি করপোরেশনের ভূমিকা দেখতে চান।
সংলাপে অংশ নিয়ে আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়র প্রার্থী অ্যাডভোকেট আজমত উল্লা খান বলেন, শুধুমাত্র নির্বাচিত মেয়র, কাউন্সিলর দিয়ে সিটি করর্পোরেশনে চালিয়ে সুশাসন পাওয়া যাবে না। এর সাথে জনগণকে সংম্পৃক্ত করতে হবে। তিনি বলেন, বিগত দিনগুলোতে সিটি করপোরেশন চলছে অর্গানোগ্রাম ছাড়া, সার্ভিস রুল ছাড়া। এটা কোনো অবস্থাতেই হতে পারে না। এটি অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনা ডুবে ছিল। তিনি বলেন, আমি নির্বাচিত হতে পারলে প্রথমেই ৬ মাসের মধ্যে একটি অর্গানোগ্রাম এবং একটি সার্ভিস রোল তৈরি করা হবে। আমি নির্বাচিত হলে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করব। দুর্ণীতি মুক্ত সিটি করপোরেশন গড়ে তুলব।
সুজনের ওই আলোচনায় অংশ নিয়ে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী গাজী আতাউর রহমান প্রার্থীদের প্রতিশ্রুতির আশ্বাস দেওয়ার আগে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হওয়া নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন। এসময় তিনি আওয়ামী লীগের প্রার্থীর কাছে জানতে চান, নির্বাচিত হলে তিনি স্বচ্ছতা আনবেন, কিন্তু তিনি স্বচ্ছ নির্বাচন চান কি না আমি জানতে চাই। তিনি বলেন, বিগত সিটি নির্বাচনের মত ভোট কারচুপির নির্বাচন আর দেখতে চান না তাঁরা। আগে সুষ্ঠু নির্বাচন পরে হল উন্নয়নের বিষয়। সুষ্ঠ ভোট করতে তিনি সুজন ও নির্বাচন কমিশনের প্রতি সহযোগিতার অনুরোধ জানান।
আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী মামুন মন্ডল বলেন, গাজীপুর থেকে সরকার যে পরিমাণ রাজস্ব আয় করে তার থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা গাজীপুরের উন্নয়ন কাজে বরাদ্দ করতে হবে। এ সময় বিভিন্ন উন্নয়ন কাজ বাস্তবায়নে দুর্নীতি হয়েছে বলেও অভিযোগ করেছেন। এ ছাড়া সাবেক মেয়র নাগরিকদের অধিকার রক্ষা না করে একক সিদ্ধান্তে সিটি করপোরেশনের টাকায় ইমাম মুয়াজ্জিনের বেতন দিয়েছেন বলে তিনি সমালোচনা করেন। তিনি সুষ্ঠ নির্বাচনের দাবী জানান।
স্বতন্ত্র প্রার্থী শাহনুর সরকার রনি বলেন, গত আঠারো সালের সিটি নির্বাচনে অনিয়ম হয়েছে। বিএনপি মনোনীত প্রার্থী আমার চাচা হাসান উদ্দিন সরকারের এজেন্টদেরকে অপহরণ করা হয়েছিল বলে অভিযোগ করেন তিনি। এসব অভিযোগ করে তিনি এই নির্বাচন সুষ্ঠু নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য হওয়ার উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। এ সময় তিনি প্রশাসন, পুলিশ এবং অন্যান্য আইন শৃঙ্খলা বাহিনী এবং নির্বাচন কমিশনসহ সকলের কাছে নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান আয়োজন করার আহ্বান জানান।
আব্দুল্লাহ আল মামুন মন্ডল বলেন, আমি মনে করি যেখানে হাজার কোটি টাকা বাজেট আমাদের সিটি কর্পোরেশনে রয়েছে। সেখান থেকে শ্রমিকদের জন্য আবাসিক ভবন নির্মান শুরু করে দেওয়া হলেও যেন একটি প্রক্রিয়া আমরা করতে পারি। যেন শ্রমিক কলোনী হিসেবে প্রতিবন্ধি ও পিছিয়ে পড়া শ্রমিকদের বসবাসের জন্য ব্যবস্থা করতে পারি। এ নগরের সর্বোচ্চ আয় শিল্প-কলকারখানা এবং শ্রমিকের ঘাম জড়ানো অংশ থেকে আসে। বাংলাদেশের সর্বোচ্য রপ্তানী আয় আসে গাজীপুর থেকে। গাজীপুরের সমৃদ্ধ যে অর্থনীতি এটাও এখানকার শ্রমিকের ঘাম জড়ানো অর্থ থেকে। সরকারের কাছে বিশেষ আবেদন থাকবে শ্রমিক অধ্যুষিত এলাকার জন্য এখান থেকে রাষ্ট্রের যে আয় হয়, তার একটা নির্দিষ্ট অংক যেন উন্নয়নের জন্য গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনকে দেয়া হয়। প্রাইভেট হাসপাতালের বর্জ্য বিশেষভাবে অপসারনের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। বায়ু দুষণ, শব্দ দূষন, পানি দূষন, নদী দূষন এবং দূষনমুক্ত নগরী গড়ে তুলতে হলে আগে বুকে ধারণ এবং মনে লালন করতে হবে। আগে সিটির উন্নয়ন করতে হবে। পরে পর্যায়ক্রমে সকল পেশাজীবী ও নগরবাসীর উন্নয়ন করা হবে। সিটি কর্পোরেশনে একটি অবাধ তথ্য সেন্টার থাকতে হবে যেন প্রতিদিন কি কাজ হচ্ছে এবং দুর্নীতি হলেই সেখানে থেকে যেন গণমাধ্যম কর্র্মীরা স্বাধীনভাবে তথ্য নিয়ে তা প্রকাশ করে নগরবাসীকে জানাতে পারবে। তিনি আরো বলেন, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, আদবিাসী, উপজাতি ও মুসলিম সকল বর্ণ পেশার মানুষের জন্য মেহনতি ইনসাফ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে একটি শান্তির নগরী গড়ে তোলাই আমার মূল লক্ষ্য। আমি বিজয়ী হলে সকল প্রার্থীর সহযোগীতা নিয়ে সিটিকে আধুনিক ও স্মার্ট নগরী হিসেবে গড়ে তুলবো।
সুজনের কেন্দ্রীয় কমিটির নির্বাহী সদস্য অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, ভোট চুরি করে নির্বাচিত হওয়া যায়, তবে মানসিক তৃপ্তি আসে না। জনগণকে দেখলে মুখ লুকায় ওসব প্রার্থীরা। তাই সুষ্ঠ ভোট অনুষ্ঠিত করতে ক্ষমতাশীন দলের প্রতি আহবান জানান সুজনের কেন্দ্রীয় এই নেতা।
তিনি প্রার্থী ও সমর্থকদের কাছে প্রত্যাশা করেন, যথাযথভাবে নির্বাচনী আচরণবিধি মেনে চলা, অর্থ বা কোনো কিছুর বিনিময়ে ভোট ক্রয় না করা, ভোটার বা প্রার্থীদের সমর্থকদের ভয়-ভীতি প্রদর্শণ না করা এবং যেকোন ফলাফল স্বাভাবিকভাবে মেনে নেওয়া।