গণবাণী ডট কম:
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে গাজীপুর-১ আসনে টানা ৪র্থবারের মতো ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন বর্ষিয়ান আওয়ামী লীগ নেতা আ ক ম মোজাম্মেল হক। তিনি এ আসনের তিনবারের সংসদ সদস্য ও বর্তমান সরকারের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী। তিনি জনপ্রতিনিধি হিসাবে ৫০ বছর যাবত জনগণের সেবক হিসেবে নিরলসভাবে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। বর্ষিয়ান এ রাজনীতিক গাজীপুর জেলা আওয়ামী পরিবারের অভিভাবক। তিনি গাজীপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। তিনি গাজীপুরের সবচেয়ে অভিজ্ঞ, বায়োজৈষ্ঠ ও গ্রহণযোগ্য আওয়ামী লীগ নেতা।
এ আসনে তিনি ছাড়াও আরো আরো ৫ জন প্রার্থী রয়েছেন। তারা হলেন, আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র ও কালিয়াকৈর আওয়ামী লীগ সম্পাদক রেজাউল করিম রাসেল (ট্রাক), তৃণমুল বিএনপির প্রার্থী ও বিএনপি নেতা তানভীর সিদ্দিকীর ছেলে চৌধুরী ইরাদ আহমদ সিদ্দিকী (প্রতীক সোনালী আঁশ), ইসলামী ঐক্যজোট মনোনীত ফজলুর রহমান (মিনার), বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রার্থী আর্শেদুজ্জামান (নোঙ্গর), বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশনের প্রার্থী মো: সফিকুল ইসলাম (ফুলের মালা)।
তবে, গাজীপুর-১ আসনে আ ক ম মোজাম্মেল হক ও রেজাউল করিম রাসেলের মধ্যে মূল প্রতিদ্বন্ধীতা হবে।
আওয়ামী লীগের একটি সূত্র জানায়, দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে তিনি সকল নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিজয়ী হয়েছেন। এসব নির্বাচনে তার প্রতিদ্বন্ধী ছিলো বিরোধী রাজনৈতিক আদর্শের নেতারা। কিন্তু এবারই প্রথম তিনি নিজ দলের স্বতন্ত্র প্রার্থীর সাথে প্রতিদ্বন্ধীতা করছেন।
স্থানীয় বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে গাজীপুরে কখনোই কোন আসনে নৌকার প্রার্থীরা পরাজিত হয়নি। কিন্তু এবার গাজীপুরের পাঁচটি আসনের মধ্যে গাজীপুর-১, গাজীপুর-২ ও গাজীপুর-৫ এ তিনটি আসনে আওয়ামী লীগের নৌকার বিপক্ষে ট্রাক প্রতীকের স্বতন্ত্র তিন প্রার্থীকে নিয়ে নৌকা বিরোধী শক্তিশালী জোট গঠন করে জোটের নেতৃত্ব দিচ্ছেন গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলম। তিনটি নির্বাচনী এলাকায় আওয়ামী লীগের তিনজন স্বতন্ত্র প্রার্থীকে নিয়ে দিনরাত অবিরাম নৌকা বিরোধী প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছেন তিনি। একই সাথে এই তিনটি আসনের নৌকা মনোনীত প্রার্থী, বর্তমান মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও সাবেক প্রতিমন্ত্রীর বিরুদ্ধে বিষোদগার করে চলেছেন তিনি। একই সাথে ভোটারদের খুশি করতে সরকারের সমালোচনা করতেও ছাড়ছেন না তিনি। যেমনটি তিনি এর আগে গত সিটি নির্বাচনে তার মায়ের পক্ষে প্রচারণার সময় করেছিলেন। জাহাঙ্গীর আলম এসব করছেন, তার ব্যক্তিগত আক্রোশ থেকে প্রতিশোধ নিতে।
মহানগর আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা জানান, ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে গোপনে ধারণ করা জাহাঙ্গীর আলমের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়। এতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মহান মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের সংখ্যা ও গাজীপুর জেলার কয়েকজন নেতা সম্পর্কে বিতর্কিত মন্তব্য করা হয়েছে বলে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা অভিযোগ করেন। তখন মহানগরীতে তাঁর বিচার দাবীতে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে ওঠে। পরে গত বছরের ১৯ নভেম্বর আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সভায় বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের সংখ্যা নিয়ে কটুক্তির অপরাধে গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদ ও দলের প্রাথমিক সদস্যপদও বাতিল করা হয়। পরে তিনি গাজীপুর সিটির মেয়র পদও হারান। এসব ঘটনার জন্য জাহাঙ্গীর আলম মুলত মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল ও মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি এড. আজমত উল্লাহ খানসহ স্থানীয় সিনিয়র নেতাদের দায়ী করেন। এ ঘটনার পর থেকে তাদের সাথে জাহাঙ্গীরের বিরোধ চরম আকার ধারণ করে।
তারপরেও আ ক ম মোজাম্মেল হকের অনুসারীরা মনে করেন, মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রী এলাকায় ব্যাপক উন্নয়ন কাজ করেছেন। এলাকায় মানুষ শান্তিতে রয়েছে। কোন রাজনৈকিক হানাহানি নেই। তিনি এলাকায় প্রচুর সময় দিয়ে থাকেন। এসব বিবেচনা নিয়ে এবারেও মানুষ তাকে ভোট দিয়ে আবারো নির্বাচিত করবেন।
গাজীপুর-১ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী মোঃ রেজাউল করিম রাসেল। তিনি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এ আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়েও পাননি। তিনি কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের ছাত্রবৃত্তি সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি ছিলেন। তিনি ২০১৪ সালে কালিয়াকৈর উপজেলা চেয়ারম্যান হন। কিন্তু ২০১৯ সালে অনুষ্ঠিত উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থীর কাছে পরাজিত হয়। পরে ২০২০ সালে কালিয়াকৈর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হন। সর্বশেষ ২০২১ সালে কালিয়াকৈর পৌরসভা নির্বাচনে নৌকা প্রতীক নিয়ে বিএনপি নেতার কাছে পরাজিত হন।
গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের ১৮ টি ওয়ার্ডসহ কালিয়াকৈরের বিভিন্ন এলাকায় জাহাঙ্গীর আলম নিজের সর্বশক্তি নিয়ে রাসেলের পক্ষে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা, গণসংযোরগ অংশ নিয়েছেন। মোজাম্মেল হকের বাড়ি গাজীপুর-২ সংসদীয় এলাকায় আর রাসেলের বাড়ি কালিয়াকৈর এলাকায়। ফলে সিটি কর্পোরেশন এলাকায় নৌকার ভোট ভাগ করতে জাহাঙ্গীর আলম আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। একইভাবে কালিয়াকৈর আঞ্চলিকতার একটি প্রবাহ তৈরি করে সেখানেও ভোট ভাগ করার জন্য রাসেল চেষ্টা করছেন। ফলে এ দুটি বিষয়কে সামনে রেখে মোজাম্মেল হক এখানে নৌকা বিরোধী একটি প্রভাবের মুখে পড়েছেন।
নির্বাচনে জাহাঙ্গীরের হাত ধরে বিজয়ী হওয়ার আশা করছেন রেজাউল। অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়কমন্ত্রী তার দীর্ঘ ৫০ বছরের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা এবং বিগত সময়ে তার উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ভোটারদের কাছে তুলে ধরছেন।
আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, আমার কাছে তার (জাহাঙ্গীরের) কথার কোন মূল্য নেই। আমি আশা করি জনগণ ব্যালটের মাধ্যেমে সকল মিথ্যাচারের জবাব দেবে। এলাকার মানুষ নৌকায় ভোট দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতকে শক্তিশালী করবে।
গাজীপুর জেলা নির্বাচন অফিস সূত্রে জানা যায়, পুর্বে গাজীপুর-১ আসনটি শ্রীপুর ও কালিয়াকৈর উপজেলা নিয়ে গঠিত ছিল। তখন এ আসনের আওয়ামী লীগের নেতা ছিলেন প্রয়াত এড. রহমত আলী আর বিএনপির নেতা ছিলেন চৌধুরী তানভীর আহমেদ সিদ্দিকী। পরবর্তীতে ২০০৮ সালে গাজীপুর-১ আসনটি ভাগ করে কালিয়াকৈর উপজেলা ও বাসন, কোনাবাড়ী, কাশিমপুর (বর্তমান গাজীপুর সিটির ১৮টি ওয়ার্ড) নিয়ে গাজীপুর-১ এবং শ্রীপুর উপজেলা ও গাজীপুর সদরের ৩টি ইউনিয়ন নিয়ে গাজীপুর-৩ আসন গঠন করা হয়।
ফলে রহমত আলী শ্রীপুর অংশের আওয়ামী লীগের নেতা আর তানভীর আহমেদ সিদ্দিকী কালিয়াকৈর অংশের বিএনপির নেতা হয়ে যান। তখন গাজীপুর-১ আসনে আওয়ামী লীগের কোন বড় নেতা ছিলেন না, যিনি নতুন এ আসনে বিএনপির প্রভাবশালী নেতাকে হারিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হতে পারতেন।
এমনি পেক্ষাপটে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ গ্রহণের জন্য আ. ক. ম মোজাম্মেল হক ওই বছরের ১৯ নভেম্বর গাজীপুর পৌরসভার মেয়র পদ থেকে পদত্যাগ করেন। ঐ নির্বাচনে আ. ক. ম মোজাম্মেল হক নৌকার প্রার্থী হিসাবে অংশ নিয়ে নব গঠিত গাজীপুর-১ আসন থেকে প্রথমবারের মতো নৌকার বিজয় নিশ্চিত করে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তারপরে তিনি এখান থেকে ২০১৪ সালের দশম ও ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও তিনি পূন:নির্বাচিত হন। পরবর্তীতে ২০১৪ সাল থেকে তিনি সরকারের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন।
গাজীপুর জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা এইচএম কামরুল হাসান আরো জানান, গাজীপুর-১ আসনটি গাজীপুর জেলার কালিয়াকৈর উপজেলা এবং গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের ১ নাম্বার ওয়ার্ড থেকে ১৮ নাম্বার ওয়ার্ড এলাকা অর্থাৎ গাজীপুর মহানগরীর বাসন, কোনাবাড়ী ও কাশিমপুর থানা এলাকা নিয়ে গঠিত। এখানে মোট ভোটার সংখ্যা ৬ লাখ ৯৫ হাজার ৮৫২ জন। এখানে পুরুষ ভোটার সংখ্যা হলো ৩ লাখ ৪৬ হাজার ৩৪৪ এবং মহিলা ভোটার সংখ্যা হলো ৩ লাখ ৪৯ হাজার ৫০৮। এ আসনের কালিয়াকৈর উপজেলা এলাকায় ভোটার সংখ্যা ৩ লাখ ৫৯ হাজার ৪৪৭ জন এবং গাজীপুর মহানগরী এলাকায় ভোটার সংখ্যা ৩ লাখ ৩৬ হাজার ৪০৫ জন। ভোট কেন্দ্র সংখ্যা ২৩৭টি, বুথ সংখ্যা হলো ১৫১২টি।
আ. ক. ম মোজাম্মেল হকের সংক্ষিপ্ত জীবনী:
আ. ক. ম মোজাম্মেল হকের রাজনৈতিক সহকর্মীদের কাছ থেকে জানা যায়, বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী। তিনি ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান থেকে মন্ত্রী হয়েছেন। তিনি মাত্র ২৭ বছর বয়সে ১৯৭৩ সালে জয়দেবপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। সেই থেকে দীর্ঘ ক্লান্তিহীন ও নিরলস যাত্রা। টানা ৫০ বছর যাবত তিনি জনগণের ভোটে নির্বাচিত জন প্রতিনিধি। এরমধ্যে ৩৫ বছর স্থানীয় সরকার প্রতিনিধি ও ১৫ বছর জাতীয় সংসদ সদস্য হিসেবে রাষ্ট্রের আইন প্রণেতা। প্রথমবার সংসদ সদস্য হয়ে তিনি ভূমি মন্ত্রনালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। পরে গত ২০১৪ ও ২০১৮ সালে টানা দুই সরকারের তিনি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রনালয়ের মন্ত্রী।
বীর মুক্তিযোদ্ধা আ. ক. ম মোজাম্মেল হক ছাত্র জীবন থেকেই তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত। তিনি ১৯৭৩ থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত ৩ বার জয়দেবপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, ১৯৮৯ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত ৪ বার গাজীপুর পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। তিনি ১৯৮৩ সালে শ্রেষ্ঠ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এবং ১৯৯৫ সালে ও ২০০৩ সালে শ্রেষ্ঠ পৌর চেয়ারম্যান হিসেবে বিদেশে শিক্ষা সফর করেন।
এছাড়াও আ. ক. ম মোজাম্মেল হকের মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদান রয়েছে। গাজীপুরে ১৯৭১ সালে ১৯ মার্চ প্রথম সশস্র প্রতিরোধ যুদ্ধের নায়ক হিসেবে কৃতিত্বের অধিকারী। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে তিনি গকুলনগর যমুনা ইয়ুথ ট্রেনিং ক্যাম্পের ডেপুটি চীফ ও পরে ক্যাম্প চীফ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে অনন্য অবদানের জন্য আ. ক. ম মোজাম্মেল হক ২০১৯ সালে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক খেতাব ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’ লাভ করেন।