নিজস্ব প্রতিবেদক, কাপাসিয়া (গাজীপুর):
মানুষকে যান্ত্রিক ও কৃত্রিম সংস্কৃতি থেকে বাঙ্গালী সংস্কৃতিতে ফিরিয়ে আনতে পৌষের শেষে দুই দিন বাংলার হাজার বছরের লোক সংস্কৃতির অন্যতম ঐতিহ্য পৌষ মেলা ও পিঠা উৎসব গাজীপুরের কাপাসিয়ায় অনুষ্ঠিত হয়েছে। নাড়ীর সাথে মেল বন্ধন সৃষ্টির টানে হাজারো নর নারী মেলায় অংশ গ্রহণ করেন।
গত শুক্র ও শনিবার উপজেলার তরগাঁও ইউনিয়নের আফজালুন্নেছা সিকদার সামাজিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রের মাঠে এই পৌষ মেলা অনুষ্ঠিত হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো: শহীদুল্লাহ শিকদার এই মেলার আয়োজন করেন। ঢাকার বিভাগীয় কমিশনার মো: সাবিরুল ইসলাম প্রধান অতিথি হিসাবে মেলার উদ্বোধন করেন। মেলায় আরো উপস্থিত ছিলেন গাজীপুরের জেলা প্রশাসক আবুল ফাতে মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম।
আয়োজক সূত্রে জানা যায়, দিন বদলের সাথে সাথে মানুষ ক্রমাগতভাবে নিজের হাজার বছরের গৌরবময় ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংষ্কৃতি ভূলে মানুষ পশ্চিমা সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে। নিজেদের অজান্তেই মানুষ শারীরিক-মানসিকভাবে দুর্বল, অবসাদগ্রস্ত ও প্রযুক্তি নির্ভর যান্ত্রিক মানুষের পরিণত হচ্ছে। এ থেকে পরিত্রাণের লক্ষেই প্রতি বছর এ মেলার আয়োজন করা হয়।
সরেজমিনে মেলা ঘুরে আম কাঁঠাল লেচু পেয়ারা গাছ ঘেরা লাল মাটির ট্যাক টিলাযর ওপর মনোমুগ্ধকর এই পৌষ মেলার আয়োজন করা হয়েছে। মেলায় একটি গ্রামীন পরিবেশ ও বাঙালির চিরাচরিত ঐতিহ্যে ফুটে ওঠেছে। গাছের ফাঁকে ফাঁকে নানা জাতের দেশীয় পিঠাপুলি-পায়েস, জিলাপি, মিষ্টান্ন, দই, মুড়ি-মুড়কি, লেইস ফিতা, চুরি, হস্তশিল্প মাটির তৈরি তৈজসপত্র, খেলনা, খেলাধুলার সামগ্রীর পসরা সাজিয়ে বসেছেন বিক্রেতারা। শিশুদের বিনোদনের জন্য রয়েছে নাগরদোলা, চড়কি, রেলগাড়ি, নৌকাদোলা, আর বড়দের জন্য ছিল আবহমান বাংলার ঐতিহ্য লোকসংগীত, বাউল গান, জারীগান, লাঠি খেলা, জাদু ও নানান রকম বিনোদন।
মেলায় এসে যে কেউ হারিয়ে যাবেন তার শৈশবে। স্মৃতি হাতরে খুঁজে পাবেন তার সোনালী অতীত। গ্রাম বাংলার আবহমান কালের ঐতিহ্য ধরে রাখতে চেষ্টা করা হয়েছে, অত্যন্ত আন্তরিকতা ও গভীর মমতায়।
মেলার আয়োজক শহীদুল্লাহ শিকদার জানান, আমাদের ছেলে বেলায় হাডুডু, দাঁড়িয়াবান্দা, কানামাছি, বউঁচি সহ অনেক খেলাধুলায় ছিল বিনোদনে এক একটি প্রকৃতি সৃষ্টি আনন্দের অফুরন্ত ভান্ডার যা আমরা কৈশোরের প্রাণ ভরে উপভোগ করেছি। বর্তমান প্রজন্ম অনেকেই এসবের কিছুই জানে না। এরা স্মার্টফোন, গেমস, ক্যাসিনো বা প্রাশ্চাত্য গেমস খেলার মত্ত। এতে করে তরুণ ও যুব সমাজ নিজেদের অজান্তেই শারীরিক-মানসিকভাবে দুর্বল অবসাদগ্রস্ত ও কৃত্রিম হানিকর প্রযুক্তিনির্ভর যান্ত্রিক মানুষের পরিণত হচ্ছে। এতে করে আমাদের সমাজের শিক্ষা, মূল্যবোধ, সামাজিক রীতি-নীতি দিন দিন অবক্ষয়ের দিকে ধাবিত হচ্ছে। যুবসমাজের একটি অংশ মাদকাসক্ত হয়ে পড়েছে।
ৃ
তিনি আরো জানান, আমাদের কৈশোরে আমরা দুরন্তপনায় ছিলাম উদ্দীপ্ত, মন ছিল অবহিত। ছিলাম সুঠাম দেহের অধিকারী। এই সকল বিষয়ে বর্তমান প্রজন্ম উদাসীন। আসলে আমরা কেউই প্রকৃত সুখী হতে চাই না। সবাই ধনী হতে চায়। ইউরোপ বা জাপানের মানুষ অন্ধ হয়ে অর্থের পিছনে দৌড়ায় না। তারা উন্নত একটি রুচিশীল বিবেকবান সমৃদ্ধ জাতি তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। তাই আমরা নিজস্ব সংস্কৃতিতে ফিরে যাই। পুনরুজ্জীবিত করে এ নিরন্তর নির্মোহ সুকুমার চর্চার মাধ্যমে সমৃদ্ধ সৎ মানবিক সমাজ নির্মাণের চেষ্টার অংশ হিসাবে এই পৌষ মেলার আয়োজন। পৌষ মেলায় ও পিঠা উৎসব আমাদের সংস্কৃতির একটি অন্যতম শক্তিশালী অনুষঙ্গ।
মেলায় অংশ নিয়ে ঢাকার বিভাগীয় কমিশনার মো: সাবিরুল ইসলাম বলেন, মেলায় যদি আধুনিক জীবনের সাথে যুক্ত সব মানুষদেরও যদি দাওয়াত দিয়ে নিয়ে আসা যেত তাহলে খুবই ভালো হতো। আমরা আমাদের নতুন প্রজন্মকে আমাদের গ্রাম বাংলার আবহমান কালের ঐতিহ্যকে তাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে পারতাম।