গণবাণী ডট কম:
আজ মহান ‘শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’। বাঙ্গালী জাতির আত্মপ্রত্যয় ও আত্মপরিচয়ের দিন। মাতৃভাষা আন্দোলনের ৭২ বছর পূর্ণ হয়েছে এদিন।
জাতি আজ রাজধানী ঢাকায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের বেদীতে পুষ্পস্তবক অর্পণ এবং বিভিন্ন স্থানে আলোচনা সভাসহ নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে জাতি একুশের মহান শহীদদের প্রতি এদিন শ্রদ্ধা জানাচ্ছে।
রাত ১২টা ১ মিনিটে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণের মধ্য দিয়ে একুশের কর্মসূচি শুরু হয়। এছাড়াও কালো ব্যাজ ধারণ, প্রভাতফেরি সহকারে আজিমপুর কবরস্থানে শহীদদের কবরে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ ও শ্রদ্ধা জানানো হয়।
শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী প্রদান করেছেন।
এদিন রাত ১২টা ১ মিনিটে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণের মধ্য দিয়ে একুশের কর্মসূচি শুরু হয়। প্রথমে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন।
জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা (ইউনেস্কো) মহান একুশের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি দেয়ার পর থেকে আন্তর্জাতিক পর্যায়েও গত দুই দশকের বেশি সময় ধরে দিবসটি পালিত হচ্ছে।
বাঙালি জাতির জন্য এই দিবসটি হচ্ছে চরম শোক ও বেদনার। অনদিকে মায়ের ভাষা বাংলার অধিকার আদায়ের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত। যে কোন জাতির জন্য সবচেয়ে মহৎ ও দুর্লভ উত্তরাধিকার হচ্ছে মৃত্যুর উত্তরাধিকার-মরতে জানা ও মরতে পারার উত্তরাধিকার। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি শহিদরা জাতিকে সে মহৎ ও দুর্লভ উত্তরাধিকার দিয়ে গেছেন।
১৯৫২ সালের এদিনে ‘বাংলাকে’ রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে বাংলার (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) ছাত্র ও যুবসমাজসহ সর্বস্তরের মানুষ সে সময়ের শাসকগোষ্ঠির চোখ-রাঙ্গানি ও প্রশাসনের ১৪৪ ধারা উপেক্ষা করে স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাজপথে নেমে আসে।
সেদিন ছাত্র-জনতার শান্তিপূর্ণ মিছিলে গুলি চালায় পুলিশ। তখন বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ঢাকা ছিল উত্তাল। ১৯৫২ সাল ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হোস্টেলের সামনে আমতলায় সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মী পরিষদের ডাকে সমাবেশে চলছিল। পাকিস্তান সরকারের জারি করা ১৪৪ ধারা ভেঙে ছাত্র-জনতার শ্লোগানে কেঁপে উঠে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। এসময় রফিক উদ্দিন আহমেদের মাথায় লাগলে তার মাথার খুলি উড়ে যায়। সাথে সাথে তাঁর মৃত্যু হয়। ভাষা আন্দোলনে তিনিই প্রথম শহীদ। তলপেটে গুলিবিদ্ধ হন আবুল বরকত। এসময় আব্দুল জব্বার মেডিকেল চত্বরে গুলীবিদ্ধ হন। পরে হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এইসব ভাষা সংগ্রামী। এছাড়া আব্দুস সালাম গুলীবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২৫ ফেব্রুয়ারি তিনি শহীদ হন। আর শফিউর রহমান ২২ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষার মিছিলে যোগ দিলে পিছন দিক থেকে গুলিবিদ্ধ হন। পরে একই দিন তিনি শাহাদত বরণ করেন। কিন্তু মোট কতজন শহীদ হন তার সঠিক সংখ্যা জানা যায়নি। কারন অনেক শহীদের লাশ মর্গ হতে মিলিটারী ও পুলিশ গুম করে ফেলে।
২১ ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষার অধিকার আদায়ে বাঙালি শহীদদের আত্মত্যাগকে স্মরণ করে আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরী লেখেন, আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফেব্রুয়ারি-আমি কি ভূলিতে পারি?
তাদের এই আত্মদান নিয়ে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ সরদার ফজলুল করিম তার ‘বায়ান্নর ও আগে’ প্রবন্ধে লিখেছেন ‘ বরকত, সালামকে আমরা ভালবাসি। কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা বরকত সালাম আমাদের ভালবাসে। ওরা আমাদের ভালবাসে বলেই ওদের জীবন দিয়ে আমাদের জীবন রক্ষা করেছে। ওরা আমাদের জীবনে অমৃতরসের স্পর্শ দিয়ে গেছে। সে রসে আমরা জনে জনে, প্রতিজনে এবং সমগ্রজনে সিক্ত। ’
এদের আত্মদানের মধ্যদিয়ে আমরা অমরতা পেয়েছি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আজ আমরা বলতে পারি দস্যুকে, বর্বরকে এবং দাম্ভিককে : তোমরা আর আমাদের মারতে পারবে না । কেননা বরকত সালাম রক্তের সমুদ্র মন্থন করে আমাদের জীবনে অমরতার স্পর্শ দিয়ে গেছেন।’
বরেণ্য শিক্ষাবিদ আবুল ফজল একুশ নিয়ে তার এক লেখায় লিখেছেন ‘মাতৃভাষার দাবি স্বভাবের দাবি। ন্যায়ের দাবি, সত্যের দাবি এ দাবির লড়াইয়ে একুশে ফেব্রুয়ারির শহীদরা প্রাণ দিয়েছেন। প্রাণ দিয়ে প্রমাণ করেছেন, স্বভাবের ব্যাপারে, ন্যায় ও সত্যের ব্যাপারে কোন আপোষ চলে না, চলে না কোন গোঁজামিল। জীবন-মৃত্যুর ভ্রকুটি উপেক্ষা করেই হতে হয় তার সম্মুখীন।
একুশে ফেব্রুয়ারি সরকারি ছুটি। এদিন দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ভবনে সূর্যোদয়ের সাথে সাথে সঠিক নিয়মে, সঠিক রং ও মাপে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত এবং কালো পতাকা উত্তোলন করা হবে।
দিবসটি পালন উপলক্ষে জাতীয় অনুষ্ঠানের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সকল স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান, জেলা ও উপজেলা প্রশাসন, বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশ মিশনসমূহ বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।
আজিমপুর কবরস্থানে ফাতেহা পাঠ ও কোরানখানির আয়োজনসহ দেশের সকল উপাসনালয়ে ভাষা শহিদদের রুহের মাগফেরাত কামনায় প্রার্থনার আয়োজন করা হয়েছে।
বাংলাদেশ মিশনসমূহ শহিদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ, রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্র মন্ত্রীর বাণী পাঠ, বঙ্গবন্ধু ও ভাষা আন্দোলন বিষয়ক আলোচনা সভা, পুস্তক ও চিত্র প্রদর্শনীসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজন করবে যেখানে বিভিন্ন দেশের কূটনীতিক এবং বাঙালি অভিবাসীদের আমন্ত্রণ জানানো হবে।
এছাড়াও দিবসটি যথাযোগ্য মর্যাদায় উদ্যাপন উপলক্ষে ঢাকা শহরের বিভিন্ন সড়কদ্বীপ সমূহ ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সুবিধা জনক স্থান সমূহে বাংলাসহ অন্যান্য ভাষার বর্ণমালা সম্বলিত ফেস্টুন দ্বারা সজ্জিত করা হয়েছে। একুশের বিশেষ অনুষ্ঠানমালা সম্প্রচার এবং ভাষা শহিদদের সঠিক নাম উচ্চারণ, শহিদ দিবসের ভাবগাম্ভীর্য রক্ষা, শহিদ মিনারের মর্যাদা সমুন্নত রাখা, সুশৃঙ্খলভাবে শহিদ মিনারে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ, ইত্যাদি জনসচেতনতা মূলক বিষয়ে সরকারি ও বেসরকারি গণমাধ্যম সমূহ প্রয়োজনীয় প্রচারের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
সংবাদপত্র সমূহে ক্রোড়পত্র প্রকাশের ক্ষেত্রে ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর অবদানের বিষয়টি বিশেষভাবে উপস্থাপন করা হবে। বাংলাদেশ বেতার, বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বেসরকারি স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলো একুশের বিশেষ অনুষ্ঠান সম্প্রচার করবে।
মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে আওয়ামী লীগ দুইদিনব্যাপি বিস্তারিত কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে একুশের প্রথম প্রহরে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর শ্রদ্ধা নিবেদনের পর কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে পুস্পার্ঘ্য অর্পণ, সংগঠনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়, বঙ্গবন্ধু ভবনসহ সারাদেশে সংগঠনের সকল কার্যালয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা অর্ধনমিত করণ ও কালো পতাকা উত্তোলন, কালো ব্যাজ ধারণ এবং প্রভাতফেরি।
এছাড়াও, ২২ফেব্রুয়ারি বিকাল ৩টায় রাজধানীর তেজগাঁওস্থ ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এতে সভাপতিত্ব করবেন।