গণবাণী ডট কম:
যুক্তরাষ্ট্রে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এক হাই-প্রোফাইল সফরের অংশ হিসেবে নিউইয়র্কের একটি অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন। সেখানে তাকে একটি গুরুত্বপূর্ণ সরকারি প্রকল্পের জন্য সম্মাননা দেয়া হবে। তবে সেলেব্রিটি ইভেন্টটি এর মধ্যে বিতর্কিত হয়ে উঠেছে। আর এই বিতর্ক শুরু হয় একটি টুইট বার্তা থেকে।
ভারতে খোলা স্থানে মলত্যাগ বন্ধ করতে দেশটির সরকার যে প্রচেষ্টা চালিয়েছে সে জন্য মি. মোদীকে স্বীকৃতি দেওয়ার কথা রয়েছে বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনের। ২রা সেপ্টেম্বর একজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী এই পুরস্কারের ঘোষণা দেন।
‘সোয়াচ ভারাত আভিয়ান’ বা ‘ক্লিন ইন্ডিয়া মিশন’ হিসাবে পরিচিত এই প্রচারণায় সারাদেশের স্যানিটেশন উন্নয়নের লক্ষ্যে দরিদ্র মানুষের জন্য অন্তত এক কোটি শৌচাগার তৈরি করে দেয়া হয়।
আপাতদৃষ্টিতে এই পুরষ্কারটি টুকরো টুকরোভাবে বিভিন্ন মতামতের জন্ম দিয়েছে। কমপক্ষে তিনজন নোবেল বিজয়ী এই পুরস্কার দিতে অসম্মতি জানিয়েছেন। এক লাখ মানুষ এ ব্যাপারে একটি পিটিশনে স্বাক্ষরও করেছে।
আলোচিত এই ইভেন্টটি সেলেব্রিটিরাও প্রত্যাখ্যান করেন - ব্রিটিশ এশিয়ান অভিনেতা জামিলা জামিল এবং রিজ আহমেদের এই অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার কথা থাকলেও পরে তারা সেখানে যাবেন না বলে জানান। এ ব্যাপারে তাদের দু’জনের কেউ কোন ব্যাখ্যা দেননি।
মি. মোদীর জন্য নির্ধারিত এই পুরষ্কারটি নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। কেননা আজ পর্যন্ত যারা গেটস ফাউন্ডেশনের “গোলকিপার” পুরষ্কার পেয়েছেন তাদের বেশিরভাগ তৃণমূলের রাজনৈতিক এবং কমিউনিটি কর্মী ছিলেন। সূত্র : বিবিসি।
কেন মি. মোদী পুরষ্কার পাচ্ছেন?
শৌচাগার বা এমনকি কলের পানির সরবরাহ না থাকায় ভারতের ১০ কোটি মানুষ খোলা জায়গায় মলত্যাগ করে। এটি একটি চিরাচরিত সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এটি একদিকে যেমন মাটি ও পানিকে দূষিত করছিল, পাশাপাশি নানা রোগও সৃষ্টি করছিল। আর নারী ও মেয়েদের নিরাপত্তার জন্যও তা হয়ে পড়েছিল ঝুঁকিপূর্ণ।
মি. মোদী এই খোলা স্থানে মলত্যাগের অভ্যাস বন্ধ করার বিষয়ে ২০১৪ সালে তার একটি উচ্চাভিলাষী প্রতিশ্রুতি পূরণের ঘোষণা দেন, যা সারা বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। এই লক্ষ্যটি ক্লিন ইন্ডিয়া মিশনের প্রধান কর্মসূচিগুলোর মধ্যে অন্যতম। মোদীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রচার-প্রচারণা জুড়েও এই বিষয়টি স্থান পায়।
তিনি এবং তাঁর ভারতীয় জনতা পার্টির নেতৃত্বাধীন সরকার একে একটি সাফল্য হিসাবে চিহ্নিত করেছেন - এবং এই বছরের নির্বাচনের আগে, মি. মোদী দাবি করেছেন যে এই কর্মসূচির কারণে ৯০% ভারতীয় শৌচাগার সেবা পেয়েছে। তিনি ক্ষমতা গ্রহণের আগে মাত্র ৪০% মানুষ এই সুবিধা পেতো।
দ্য বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন বিবিসিকে এক বিবৃতিতে জানিয়েছে যে, “জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার অর্জনের পথে ভারত স্যানিটেশন উন্নয়নে যে অগ্রগতি করছে” সেজন্য তারা মোদীকে এই সম্মান করছেন।
প্রকল্পটি কতটা সফল হয়েছে?
প্রকল্পটির সফলতা মূলত নির্ভর করছে মানুষ কিভাবে সেটাকে মূল্যায়ন করছে - তার উপর।
এটি সত্য যে শৌচাগারের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে বিবিসির একটি তদন্তে দেখা গেছে যে এসব শৌচাগারের মধ্যে অনেকগুলো কাজ করছে না। আবার অনেকে বিভিন্ন কারণে ব্যবহার করছে না। মূলত প্রবাহিত পানির অভাব, শৌচাগারগুলো দেখভাল না করা সেইসঙ্গে দীর্ঘদিনের অভ্যাসের কারণে অনেকে শৌচাগার থাকা সত্ত্বেও ব্যবহারে আগ্রহী হচ্ছেন না।
সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে যে উত্তর ভারতের কিছু অংশের লোকেরা খোলা জায়গায় মলত্যাগ করতে পছন্দ করতো কারণ, তারা এটিকে আরও “আরামদায়ক” বলে মনে করেন। তাদের মতে, এটি একটি “স্বাস্থ্যকর পুণ্যবান জীবনের অংশ”।
আরেকটি সাধারণ সমস্যা হ’ল সরকার দারিদ্র মানুষেদের বাড়িতে একটি করে টয়লেট তৈরির জন্য ভর্তুকি দেবে বলে জানিয়েছে।
কিন্তু সেই ভর্তুকি এক বছর ধরে কয়েকটি কিস্তিতে দেয়া হয়। তাই অনেক দরিদ্র পরিবারকে শৌচাগারের নির্মাণ শেষ হওয়ার জন্য কয়েক মাস অপেক্ষা করতে হয়।
“আবার অনেক সুবিধাভোগীরা শৌচাগারের নির্মাণ শুরু করলেও, শেষ করছেনা,” -স্যানিটেশন উন্নয়নে কাজ করে এমন একটি অলাভজনক সংস্থা মাহিলা সেওয়া ট্রাস্টের সিরাজ হিরানি এ কথা বলেছেন।
সংস্থাটির সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার হিসাবে মি. হিরানী ক্লিন ইন্ডিয়া প্রকল্প বাস্তবায়নে গ্রামীণ ও নগর সরকারের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছেন। তাঁর অন্যান্য বড় উদ্বেগের জায়গা হল - এই ভর্তুকিটি নর্দমা স্থাপনের পেছনে ব্যয় করার জন্য দেয়া হয় না। এ কারণে গ্রামাঞ্চলের লোকেরা শেষ পর্যন্ত গর্ত শৌচাগার নির্মাণ করেন।
মি: হিরানীর আশঙ্কা যে, উপকূলীয় অঞ্চলে, যেখানে মাটিতে পানির উচ্চতা বেশি, সেখানে এই শৌচাগারগুলোর কারণে ভূগর্ভস্থ পানি এবং মাটির দূষিত হতে শুরু করবে।
মি. হিরানী বলেছেন, উন্মুক্ত মলত্যাগ “উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস” পেয়েছে, তবে “সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হ’ল আমরা কীভাবে এটি টিকিয়ে রাখতে পারি?”
তিনি আরও বলেছেন যে সরকারের সাফল্য পরিমাপের জন্য যে জরিপ করা হয়, তার তথ্য পুরোপুরি নির্ভর করে অবকাঠামোর অস্তিত্বের উপর। যেমন কয়টি শৌচাগার নির্মাণ হয়েছে সেটাই দেখা হচ্ছে।
কিন্তু এগুলো ঠিকমতো ব্যবহার হচ্ছে কিনা, আচরণগত পরিবর্তন এসেছে কিনা — সেগুলো উপেক্ষিত থেকে যায়।
তিনি বলেছেন, ক্লিন ইন্ডিয়া মিশন একটি “দুর্দান্ত আইডিয়া” যা খোলা আকাশের নীচে মলত্যাগের বিষয়টিকে সামনে নিয়ে এসেছে। আর এজন্য মি. মোদী এই পুরষ্কারের যোগ্য।
তবে তিনি আশঙ্কা করেন যে এই স্বীকৃতিকে একটি বিজয় হিসাবে দেখা হতে পারে।
“নিজেকে প্রমাণ করা ঠিক আছে, তবে নিজেকে প্রমাণ করার সময় আপনাকে অবশ্যই উন্নতি করতে হবে।”
সমালোচকরা কী বলছেন?
সমালোচকরা যখন মোদীর এই প্রকল্পটির প্রশ্নবিদ্ধ বিষয়গুলো চিহ্নিত করছিলেন, তখনই বড় সমালোচনাগুলো ব্যক্তি নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধেই ওঠে।
২০০২ সালে নিজ রাজ্য গুজরাটে সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় জড়িত থাকার অভিযোগে কয়েক বছর মি. মোদী যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে নিষিদ্ধ ছিলেন।
ভারতের এই প্রধানমন্ত্রী অনেকের কাছে প্রশংসিত হলেও তিনি একজন বিভাজনকারী ব্যক্তিত্ব হিসেবে পরিচিত। তার বিরুদ্ধে প্রায়শই সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে বিভাজনমূলক বক্তৃতা এবং সহিংসতার অভিযোগ উঠেছে।
ভারত-শাসিত কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা ৫ই আগস্ট ছিনিয়ে নেওয়ার পরে সেখানে মি. মোদীর নির্দেশ যে অচলাবস্থার সৃষ্টি করা হয়েছে, সেটাও নিয়ে সমালোচনা হয়েছে।
কাশ্মীরের হাজার হাজার রাজনৈতিক নেতা-কর্মী, ব্যবসায়ী ও আন্দোলনকারীকে আটক করা হয়েছে।
যোগাযোগ অনেকাংশেই বন্ধ রয়েছে। পুরো রাজ্য জুড়ে অতিরিক্ত নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েন। সেইসঙ্গে এই নিরাপত্তা বাহিনী কর্তৃক ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে।
“এই পুরষ্কারের সময় - কাশ্মীর এমন একটি বিষয় যা কেবল কাশ্মীরিদেরই নয়, আমাদেরও তাড়া করে বেড়ায়,” বলেন, সামাজিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক শিব ভিশওয়ানাথন বিবিসিকে এ কথা বলেন।
“[কাশ্মীরে] ট্রমা ক্লিনিকের অনেক প্রয়োজন রয়েছে। ‘গেটস ফাউন্ডেশন’ কি অধিকারের নামে এই ক্লিনিকগুলো প্রতিষ্ঠা করবে? [মোদী] সরকার কি এর অনুমোদন দেবে?”
ডা. ভিশওয়ানাথন এটাও বলেন যে, “বিল গেটসের মতো পরোপকারীরা মি. মোদী সরকারকে বৈধতা দিয়েছেন, এই বিষয়টি এড়িয়ে চলাও কঠিন। “বিষয়টিকে সহজভাবে দেখলে হবে না। এতে এটা নিশ্চিত যে [গেটস] ফাউন্ডেশন ভারতে একটি ভাল সময় কাটাচ্ছে।”
মি. মোদী এই সমালোচনার জবাব দেননি, তবে তিনি পুরষ্কারের জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে টুইট করেছেন।
ফাউন্ডেশন কী বলছে?
বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন কখনও আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়নি যে মি. মোদী ২০১৯ সালে ‘গোলকিপার’ পুরষ্কার পাবেন - এবং পুরষ্কারের ওয়েবসাইটটি জানিয়েছে যে চলতি বছরের বিজয়ীদের নাম এই ইভেন্টে প্রকাশ করা হবে।
কিন্তু সমালোচনা বাষ্প ছড়াতে থাকলে, এটা স্বীকার করে নেয়া হয়েছিল যে মি. মোদী প্রকৃতপক্ষে গ্রাহকদের মধ্যেই একজন।
মি. মোদী প্রথম এই পুরষ্কার প্রাপ্ত রাজনীতিবিদ নন - লাইবেরিয়ার প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি এলেন জনসন সিরলিফকে ২০১৩ সালে সম্মানিত করা হয়েছিল।
নরেন্দ্র মোদীকে এই সম্মাননা দেওয়ার সিদ্ধান্তের স্বপক্ষে ফাউন্ডেশন বিবিসি তাদের বিবৃতিতে জানায় যে “স্যানিটেশন এর আগে কখনই এতোটা মনোযোগ পায়নি” এবং “অনেক সরকার এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি নন, কারণ এর কোন সহজ সমাধান নেই”।
“সোয়াচ ভারাত মিশনের আগে, ভারতে ৫০ কোটিরও বেশি মানুষের নিরাপদ স্যানিটেশন ব্যবহারের সুযোগ ছিল না। যা এখন, বেশিরভাগ লোকেরই আছে। এখনও অনেক দীর্ঘ পথ পাড়ি দেয়া বাকি আছে। তবে ভারতে স্যানিটেশনের সুযোগ সৃষ্টির প্রভাব ইতিমধ্যে উপলব্ধি করা যাচ্ছে। সোয়াচ ভারাত মিশন বিশ্বের সেইসব দেশের জন্য একটি মডেল হতে পারে যাদের জরুরিভাবে দরিদ্রতম মানুষের জন্য জরুরি ভিত্তিতে স্যানিটেশনের সেবা প্রয়োজন।”