গণবাণী ডট কম:
মিয়ানমারে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের উপর নির্যাতনের ব্যাপারে তদন্তের অনুমোদন দিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) বিচারকেরা। প্রসিকিউশনের আবেদনের প্রেক্ষিতে বৃহস্পতিবার এই অনুমতি দেওয়া হলো। চলতি বছরের জুলাইয়ে আইসিসি’র প্রধান প্রসিকিউটর ফাতু বেনসুদা মিয়ানমারে রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সংগঠিত সহিংসতার বিষয়ে তদন্তের আবেদন করার প্রেক্ষিতে এই অনুমতি দেওয়া হলো।
আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত বা আইসিসির এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, এই তদন্ত বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের পরিস্থিতি বলে গণ্য হবে। আইসিসির প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, চলতি বছর জুলাইয়ে মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সংগঠিত অপরাধের বিষয়ে আইসিসির এখতিয়ারের মধ্যে থেকে প্রসিকিউটর তদন্ত শুরুর জন্য যে আবেদন করেছিলেন সেটিই অনুমোদন করছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের প্রি ট্রায়াল চেম্বার-৩। চেম্বার ঘটনার শিকার অসংখ্য মানুষের পক্ষ থেকে আসা অভিযোগ সমূহের বিষয়ে মতামত পেয়েছে বলেও এতে উল্লেখ করা হয়েছে।
বিবৃতিতে হেগের আদালত বলেছে, ‘এটা বিশ্বাস করা যুক্তিযুক্ত যে বিস্তৃতভাবে এবং/অথবা নিয়মতান্ত্রিকভাবে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে এমন সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে যা মানবতা বিরোধী অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।’
‘চেম্বার তাই বাংলাদেশ/মিয়ানমারের পরিস্থিতিতে তদন্তের অনুমতি দিচ্ছে’।
২০১৭ সালের ২৫ অগাস্ট রাখাইনে নিরাপত্তা বাহিনীর বেশ কিছু স্থাপনায় ‘বিদ্রোহীদের’হামলার পর রোহিঙ্গাদের গ্রামে গ্রামে শুরু হয় সেনাবাহিনীর অভিযান। সেনাবাহিনী সেখানে নির্বিচারে রোহিঙ্গাদের হত্যা, ধর্ষণ, বাড়িঘর আগুনে পুড়িয়ে দেয়। ফলে প্রাণ বাঁচাতে লাখ লাখ রোহিঙ্গা ছুটে আসে বাংলাদেশে।
আইসিসির রেজিস্ট্রি অনুযায়ী নির্যাতনের শিকার হওয়া বিভিন্ন ব্যক্তি সর্বসম্মতভাবে তদন্ত শুরু করার দাবি করেছেন। “এবং তাদের অনেকের মতামত অনুযায়ী একমাত্র বিচার ও দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা গেলেই এই ধরনের সহিংসতা ও নির্যাতনের অবসান হতে পারে”।
চেম্বারের বক্তব্য হলো যে আদালত সদস্য দেশের ভূখণ্ডে কোনো অপরাধ মূলক কর্মকাণ্ডের অংশ হিসেবে হওয়া অপরাধ এখতিয়ার ভুক্ত হিসেবে বিবেচনা করতে পারে।
“যদিও মিয়ানমার সদস্য দেশ নয়, তবে বাংলাদেশ আইসিসি রোম সনদ ২০১০ সালে অনুস্বাক্ষর করেছে। আর প্রাপ্ত তথ্য পর্যালোচনা করে আদালত মনে করেছে যে, এটা বিশ্বাস করার কারণ আছে যে ব্যাপক ভিত্তিক বা সিস্টেমেটিক সহিংসতা হয়েছে যার কারণে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জোরপূর্বক দেশত্যাগের মতো ঘটনা মানবতা বিরোধী অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
আদালত মনে করে এখতিয়ারে নেয়ার মতো অন্য অপরাধ হয়েছে কিনা তা আর পর্যালোচনার প্রয়োজন নেই যদিও এ ধরণের কথিত অপরাধ ভবিষ্যতে কৌসুলিদের তদন্তের অংশ হতে পারে”।
তথ্য প্রমাণ অনুযায়ী প্রায় ছয় লাখ থেকে দশ লাখ রোহিঙ্গা মুসলিম মিয়ানমার থেকে বাস্তুহারা হয়ে প্রতিবেশী বাংলাদেশে গেছে এমন জবরদস্তিমূলক কার্যক্রমের কারণেই। এর ধারাবাহিকতায় এমন অপরাধ বা ভবিষ্যতেও হতে পারে এমন অপরাধের সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আদালত তদন্ত শুরুর অনুমতি দিয়েছ।
এক্ষেত্রে দেখা হবে সেটি আদালতের এখতিয়ার ভুক্ত কিনা বা অন্তত এটি বাংলাদেশের ভূখণ্ডের কোথাও সংশ্লিষ্ট কিনা বা অন্য সদস্য দেশের ভূখণ্ডের মধ্যে কিনা বা এটা বাংলাদেশ রোম সনদে স্বাক্ষরের পর হয়েছে কিনা।
পরবর্তী পদক্ষেপ কি হবে?
কৌঁসুলির অফিস এখন নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে, স্বাধীন এবং নিরপেক্ষভাবে তথ্য প্রমাণ সংগ্রহের কাজ শুরু করবে। প্রয়োজনীয় আলামত সংগ্রহের জন্য এই তদন্ত দল যতদিন প্রয়োজন সময় নিতে পারবে।
আইসিসি বলছে, যদি কোন ব্যক্তির সম্পৃক্ততার পক্ষে যথেষ্ট প্রমাণাদি সংগ্রহ হয়, তাহলে তদন্ত কৌসুলি প্রি-ট্রায়াল চেম্বার তিন এর বিচারকের কাছে ঐ ব্যক্তির নামে আদালতে হাজির হবার জন্য সমন জারি করা অথবা গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির আবেদন করতে পারবেন। চেম্বার বিচারকের ইস্যুকৃত গ্রেপ্তারি পরোয়ানা যাবে সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রের কাছে।
রোম সনদের নীতিমালা অনুযায়ী ২০০২ সালে প্রতিষ্ঠিত এই আদালত বিচারের মাধ্যমে যে কোনো ব্যক্তি বা সংগঠনকে দোষী সাব্যস্ত করতে পারে। এমনকি গ্রেফতারি পরোয়ানাও জারি করতে পারে সংস্থাটি।
তবে এর নিজস্ব কোনো বাহিনী না থাকায় অভিযুক্তদের আটক বা গ্রেপ্তার করতে বা দণ্ড কার্যকর করতে পারে না। এ জন্য তারা সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্র ও অন্যান্য রাষ্ট্রকে অভিযুক্তকে গ্রেফতারের আহ্বান জানায়।
জুলাইতে বাংলাদেশে এসেছিলো আইসিসি প্রতিনিধি দল:
২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে রোহিঙ্গা ইস্যুতে মানবতা বিরোধী অপরাধের দায়ে মিয়ানমারের বিচারের এখতিয়ার আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের আছে বলে সিদ্ধান্ত ঘোষণার পর প্রাথমিক তথ্য প্রমাণ সংগ্রহের কাজ শুরু হয়েছিলো।
এ বছরের মার্চে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের প্রধান প্রসিকিউটর ফাতো বেনসুদা, স্ব-উদ্যোগে মিয়ানমারের রাখাইনে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধ যাচাইয়ের সিদ্ধান্ত নেন। এরপর জুলাই মাসের চার তারিখে রোহিঙ্গাদের ওপর যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত হয়েছে কিনা তা নিয়ে তদন্ত শুরু করতে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত আইসিসির অনুমতি চান প্রসিকিউটর ফাতো বেনসুদা। তার তদন্ত দল বাংলাদেশে এসে কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের কাছ থেকে ব্যাপক তথ্য সংগ্রহ করে। এরপর প্রাথমিক তদন্ত শেষে পূর্ণ তদন্তের জন্য আবেদন করেন ফাতো বেনসুদা যাতে সায় দিলো আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের বিচারকরা।
আইসিসির বিচারকরা সায় দেওয়ায় রোহিঙ্গা মুসলিমদের নিপীড়নের অভিযোগের তদন্তে এটাই কোনো আন্তর্জাতিক আদালতের প্রথম উদ্যোগ। যদিও শুরু থেকেই অনেকে এ প্রক্রিয়ার কার্যকারিতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। কারণ মিয়ানমার আইসিসির সদস্য রাষ্ট্র নয়। একইভাবে আইসিসির প্রতিনিধি দলকেও রাখাইনে পরিদর্শনে যাবার অনুমতিও দেয়া হয়নি।
এদিকে, আনুষ্ঠানিক তদন্ত শুরুর অনুমোদন পাবার পর আইসিসির সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন প্রসিকিউটর বেনসুদা।
এক বিৃবতিতে তিনি জানিয়েছেন, মিয়ানমারে নির্যাতনের শিকার ব্যক্তিদের কাছে আইসিসির এ সিদ্ধান্ত একটি ইতিবাচক বার্তা দেবে।
আইসিসি এ পর্যন্ত ৩৬ জনকে বিভিন্ন অপরাধে অভিযুক্ত করেছে। এদের মধ্যে রয়েছেন উগান্ডার বিদ্রোহী নেতা জোশেফ কোনি, সুদানের প্রেসিডেন্ট ওমর আল-বশির, কেনিয়ার প্রেসিডেন্ট উহুরু কেনিয়াত্তা, লিবিয়ার প্রয়াত নেতা মুয়াম্মার আল-গাদ্দাফি ও আইভরি কোস্টের প্রেসিডেন্ট লরেন্ট জিবাগবো। সূত্র : বিবিসি ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম।