গণবাণী ডট কম:
ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ
তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে, শোন আসমানী তাগিদ।
তোর সোনা-দানা, বালাখানা সব রাহে লিল্লাহ দে যাকাত,
মুর্দা মুসলিমের আজ ভাঙাইতে নিঁদ
ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ।
‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’, গানটি বাংলাদেশে রীতিমতো যেন ঈদ উৎসবের জাতিয় সঙ্গীত অথবা ঈদের দিনের আবহ সঙ্গীত হয়ে উঠেছে। আর এ গানটি যিনি রচনা করেছিলেন, সে প্রাণের কবি, গানের কবি, প্রেমের কবি, সাম্যের কবি, বিরহ-বেদনার কবি, বিদ্রোহের কবি বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২১তম জন্মবার্ষিকী।
আজ সোমবার ১১ জ্যৈষ্ঠ। বাংলা ১৩০৬ সালের ১১ জৈষ্ঠ (১৮৯৯ খ্রি:) কাজী নজরুল ইসলামের জন্ম গ্রহণ করেন। পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে। তার পিতার নাম কাজী ফকির আহমেদ, মা জাহেদা খাতুন। দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করায় দুঃখ-দারিদ্র্য ছিল তার নিত্যসঙ্গী। তার ডাকনাম ছিল দুখু মিয়া।
তিনি বেঁচে ছিলেন ৭৭ বছর। কিন্তু তার মধ্যে ৩৪ বছর অসহনীয় নির্বাক জীবন কাটিয়েছেন। জন্মের পর থেকে মাত্র ৪৩ বছর বয়স পর্যন্ত স্বাভাবিক জীবন কাটিয়েছেন। এর মাঝে সাহিত্য রচনার কাল ছিল মাত্র ২৪ বছর। তিনি নির্বাক হয়েছিলেন ৭৭ বছর আগে, তার মৃত্যুর পরও আমরা পেরিয়ে এসেছি প্রায় ৪৩ বছর। তার মানে প্রায় আট দশক তিনি বিচ্ছিন্ন দ্বীপের বাসিন্দা। তার পরও বাঙালির জীবনে নজরুলের দিগন্তবিস্তারি প্রভাব রয়েছে! কেন?
গবেষকরা বলছেন, সাহিত্য রচনার সময়কালের ব্যাপ্তি যাই হোক না কেন নজরুলের প্রভাব শতাব্দী পেরিয়ে আজো সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। মানবতাবাদী কবি নজরুল একুশ শতকে এসে হয়ে উঠেছেন মনুষ্যত্বের কবি। যখন দেশে দেশে সাম্প্রদায়িকতা, জঙ্গিবাদ, ধর্মীয় কুসংস্কার বাড়ছে। তার বিপরীতে, অসাম্প্রদায়িক ও মানবতার কবি নজরুল চর্চার বিকল্প নেই।
তিনি ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে তার লেখনী ধূমকেতুর মতো আঘাত হেনে জাগিয়ে দিয়েছিল ভারতবাসীকে। নজরুল তার কবিতা, গান, উপন্যাসসহ অন্যান্য লেখনী ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে পরাধীন ভারতে বিশেষ করে অবিভক্ত বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতা, সামন্তবাদ, সাম্রাজ্য ও উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বলিষ্ঠ ও সোচ্চার কণ্ঠ ছিলেন। সে কারণে ইংরেজ সরকার তার গ্রন্থ ও রচনা বাজেয়াপ্ত করেছে এবং কারাদণ্ড দিয়েছে। কারাগারেও বিদ্রোহী নজরুল টানা ৪০ দিন অনশন করে বিদেশি সরকারের জেলজুলুমের প্রতিবাদ করেছিলেন।
রবীন্দ্রসৃষ্ট বিশাল জগতের পাশে কবি নজরুল গড়ে তোলেন নিজস্ব জগৎ। সেখানে ফুটিয়ে তোলেন স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ নজরুলের সদম্ভ অভ্যুদয়কে এই বলে স্বাগত জানিয়েছিলেন, ‘আয় চলে আয় রে ধূমকেতু, আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু’। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে ‘বিদ্রোহী কবি’ এবং আধুনিক বাংলা গানের ‘বুলবুল’ নামে খ্যাত কাজী নজরুল ইসলাম বিশ শতকের বিশ ও ত্রিশের দশকে উপমহাদেশের অবিভক্ত বাংলার সাংস্কৃতিক জগতে সবচেয়ে বর্ণাঢ্য ব্যক্তিত্ব ছিলেন।
তার কবিতা ‘চল চল্ চল’ বাংলাদেশের রণসঙ্গীত। দ্রোহ, প্রেম, মানবতা কবির রচনাকে করেছে চিরন্তন, নিয়ে গেছে গণমানুষের কাছাকাছি। কবিতায় বলেছেন, ‘গাহি সাম্যের গান/ মানুষের চেয়ে বড়ো কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান…’। কবির এমন অজস্র রচনা ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে বীর বাঙালিদের দিয়েছে শক্তি ও যুগিয়েছে প্রেরণা। এখনো সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে, শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে, সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও সংগ্রামে তার রচনা আমাদের গভীরভাবে উদ্দীপ্ত করে।