গণবাণী ডট কম:
গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের (জিএমপি) নতুন কমিশনার হিসেবে বুধবার (১৩ জুলাই) দুপুরে যোগদান করেছেন মোল্যা নজরুল ইসলাম।
গত ৩০ জুন (বৃহস্পতিবার) স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের পুলিশ শাখা-১-এর উপসচিব ধনঞ্জয় কুমার দাস স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনে গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের (জিএমপি) কমিশনার হিসেবে মোল্যা নজরুল ইসলামকে নিয়োগ দেওয়া হয়।
মোল্যা নজরুল ইসলাম গাজীপুর মহানগর পুলিশের বিদায়ী কমিশনার খন্দকার লুৎফুল কবিরের স্থলাভিষিক্ত হলেন। গত ৩০ জুন (বৃহস্পতিবার) গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের (জিএমপি) কমিশনার খন্দকার লুৎফুল কবিরকে উপ-পুলিশ মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) হিসেবে পুলিশ অধিদপ্তরে (পুলিশ সদর দপ্তর) পদায়ন করা হয়েছে।
মোল্যা নজরুল ইসলাম গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের সদর দপ্তরে যোগদানের পর তাঁকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানান বিদায়ী কমিশনার খন্দকার লুৎফুল কবির ও গাজীপুর মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার বরকতুল্লাহ খানসহ জিএমপির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। পরে তিনি সহকর্মীদের সঙ্গে সংক্ষিপ্ত মতবিনিময় করেন।
:মোল্যা নজরুল ইসলামের জীবনী:
মোল্যা নজরুল ইসলাম, বিপিএম (বার), পিপিএম (বার) ২০০১ সালে ২০তম বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে বাংলাদেশ পুলিশে যোগদান করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগ থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রী সম্পন্ন করেন। নড়াইলের সম্ভ্রান্ত এক মুসলিম পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন ম্যোল্যা নজরুল ইসলাম। পিতা মৃত মোঃ হাশেম মোল্যা এবং মাতা রেনু হাশেমের ৬ সন্তানের মধ্যে মোল্যা নজরুল ইসলাম ছেলেদের মধ্যে জেষ্ঠ্য।
প্রায় ২২ বছরের চাকুরি জীবনে পুলিশের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন ইউনিটে নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন মোল্যা নজরুল ইসলাম। দায়িত্ব পালনকালে চৌকষ এ পুলিশ কর্মকর্তা দেশের আলোচিত ঘটনা যেমন উদঘাটন করেছেন, তেমনি নেতৃত্ব দিয়েছেন চাঞ্চল্যকর বহু মামলারও। সাহসী এবং বীরত্বপূর্ণ সেসব কাজের স্বীকৃতিস্বরুপ একাধিকবার তিনি পুলিশের সর্বোচ্চ পদকে ভূষিত হয়েছেন।
২০০২ সালে সারদায় মৌলিক প্রশিক্ষণ শেষে ৬ মাসের মাঠ পর্যায়ের বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য মোল্যা নজরুল ইসলাম পটুয়াখালী জেলায় যোগদান করেন। সাফল্যের সাথে মাঠ পর্যায়ের বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জনের পর তিনি বদলিসূত্রে এপিবিএন এ যোগদান করেন এবং তাকে খাগড়াছড়ির দূর্গম এলাকা মহালছড়িতে পদায়ন করা হয়। এরপর ২০০৪ সালে তিনি র্যা ব সদরদপ্তরে বদলিসূত্রে যোগদান করেন। এপিবিএন এবং র্যা বে দক্ষতার পরিচয় দিয়ে ২০০৬ সালে তিনি জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে গমন করেন। ম্যোল্যা নজরুল ইসলামই একমাত্র পুলিশ কর্মকর্তা যিনি মিশনে সাহসিকতাপূর্ণ কাজের জন্য ‘পিপিএম’ পদক অর্জন করেছেন।
দেশে ফিরে ২০০৭ সালে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হিসেবে যোগ দেন গাইবান্ধা জেলায়। এ সময় তিনি নয় মাস অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে ভারপ্রাপ্ত পুলিশ সুপারের দায়িত্বও পালন করেন।
এরপর ২০১২ সালে পুলিশ সুপার হিসেবে পদোন্নতি পেলে তাকে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপ-পুলিশ কমিশনারের (ডিসি ডিবি) দায়িত্ব দেওয়া হয়। ডিসি ডিবি থাকাকালে বেশ কিছু চাঞ্চল্যকর মামলা তদন্ত করে সত্য উদঘাটন করেন মোল্যা নজরুল ইসলাম। এরমধ্যে সৌদি দূত খালাফ আল আলী হত্যাকান্ড, ব্লগার রাজীব হত্যাকান্ড, ডাঃ নিতাই হত্যাকান্ডসহ অসংখ্য ক্লুলেস হত্যা, ডাকাতি, গাড়ী ছিনতাইয়ের মামলার কথা উল্লেখ করা যায়। এ সময় রাষ্ট্র ও সরকারের অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজে নেতৃত্ব দিয়ে বিশেষ নজর কাড়েন গোয়েন্দা কর্মকর্তা মোল্যা নজরুল ইসলাম। ডিবিতে থাকাকালীন সাহসী কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ তাকে বিপিএম ও পিপিএম পদকে ভূষিত করা হয়।
২০১৫ সালের আগুন সন্ত্রাসের এক কঠিন পরিস্থিতিতে মোল্যা নজরুল ইসলামকে জয়পুরহাট জেলার পুলিশ সুপারের দায়িত্ব দিয়ে প্রেরণ করা হয়। সারা দেশে কিছুটা স্থিমিত হলেও জয়পুরহাট তখনও সন্ত্রাসীদের দখলে। প্রতিদিনই আগুন জ্বলছিল। মোল্যা নজরুল দায়িত্ব নিয়ে আগুন সন্ত্রাস নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি পুরো জেলার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নে অভূতপূর্ব সাফল্যের স্বাক্ষর রাখেন। তিনি মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। আক্কেলপুর পৌরসভাকে মাদকমুক্ত, গোপীনাথপুর ইউনিয়নকে ডাকাতমুক্ত এবং পাঁচবিবি পৌরসভাকে বাল্যবিবাহ মুক্ত ঘোষণা করেন। কেবল নির্মূল নয়, মাদক ব্যবসায়ী ও ডাকাতদের পুনর্বাসনেরও ব্যবস্থা করেন তিনি।
২০১৬ সালে জয়পুরহাট মিশন শেষে মোল্যা নজরুল ইসলামকে বিশেষ পুলিশ সুপার পদে সিআইডিতে নিয়ে আসা হয়। সিআইডিতে মাত্র ৩ বছরের দায়িত্বকালে বৈচিত্র্যময় এবং চাঞ্চল্যকর বিভিন্ন ঘটনা উদঘাটনে নেতৃত্ব দিয়ে দেশজুড়ে আলোচিত ও প্রশংসিত হন ম্যোল্যা নজরুল ইসলাম। তিনি সিআইডিতে যোগ দেওয়ার সময় সারা দেশে পাবলিক পরীক্ষাগুলোয় প্রশ্নফাঁসের এক মহোৎসব চলছিল। রাষ্ট্রপ্র্রধানের বিশেষ নির্দেশনা বাস্তবায়নে প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিরুদ্ধে নিবিড় অনুসন্ধান শুরু করেন তিনি। ফলস্বরুপ ধরা পড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি ও বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের সর্ববৃহৎ চক্র। গ্রেপ্তার হয় ৪৭ জন আসামী, সব মিলে ১২৫ জনের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশীট দেওয়া হয়। এদের মধ্যে ৮৭ জন শিক্ষার্থীকে আজীবন বহিস্কার করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। ঘটনাটি দেশজুড়ে তুমুল আলোচিত হয়। দীর্ঘ এই অভিযানটিকে দেশি-বিদেশী মিডিয়ায় ÔGood job done by Police’ হিসেবে বিশেষভাবে উল্লেখ করে ব্যাপক প্রচার করা হয়।
এছাড়াও মাদক থেকে মানি লন্ডারিংয়ের প্রথম মামলায় রাষ্ট্রের অনুকূলে মাদক ব্যবসায়ীদের শতকোটি টাকার সম্পদ বাজেয়াপ্ত করাও আরেকটি বড় অর্জন। মোল্যা নজরুল ইসলামের নেতৃত্বে সিআইডির মানিলন্ডারিং অনুসন্ধান টিম টেকনাফের মাদক কারবারিদের মনে রীতিমত আতঙ্ক ধরিয়ে দেন। এর বাইরেও সিআইডিতে থাকাকালীন মানব পাচার, অভিনব প্রতারণা, অর্থ আত্মসাৎ, সাইবার অপরাধ নিয়ন্ত্রণসহ অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ ঘটনায় সাহসী ও দক্ষ ভূমিকা পালন করেছেন তিনি। দীর্ঘদিনের ক্লুলেস মাওলানা ফারুকী হত্যা মামলার রহস্য উদঘাটনসহ বেশ কিছু জঙ্গি সংক্রান্ত মামলারও তদন্ত তদারকি করেন তিনি।
বাংলাদেশ পুলিশে মূলত মোল্যা নজরুল ইসলামের নেতৃত্বেই মানি লন্ডারিং মামলার গোড়াপত্তন হয়। জঙ্গি অর্থায়ন, মাদক, প্রতারণা, সংঘবদ্ধ অপরাধসহ মোট ২৭ টি প্রেডিকেট অফেন্সের অধিকাংশ ঘটনায় মানি লন্ডারিং মামলার সূচনাকারী প্রথম কোনো পুলিশ কর্মকর্তা তিনি। এ সকল মামলায় অপরাধীদের বাড়ি, গাড়ি, ব্যাংকে জমানো কোটি কোটি অবৈধ নগদ অর্থ বাজেয়াপ্ত করতে ভূমিকা পালন করেন, যা পুলিশ বাহিনীতে বিরল।
এছাড়াও সিআইডিতে তিনি সাইবার ক্রাইম ইউনিটের ৩৪২ টি নতুন পদ সৃজনে সরকারের সানুগ্রহ অনুমোদন আদায়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। সিআইডিতে বিশেষ পুলিশ সুপার থাকাকালীন সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের টাকা চুরির মামলাটি গুরুত্বের সাথে তদারকি করে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধন করেন। এ সকল কাজ করতে গিয়ে বিভিন্ন সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যানসহ পুলিশ ও সরকারের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অভিনন্দন ও প্রশংসা কুড়িয়েছেন।
২০১৯ সালে অতিরিক্ত উপ-মহাপরিদর্শক (এডিশনাল ডিআইজি) পদে পদোন্নতি পাওয়ার পর মোল্যা নজরুল ইসলামকে দায়িত্ব দেওয়া হয় আরেক বিশেষায়িত ইউনিট নৌ-পুলিশে। সেখানেও দক্ষতার স্বাক্ষর রাখেন তিনি। কয়েক কোটি মিটার কারেন্ট জাল ধ্বংস করে ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধিতে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। এছাড়াও ডাকাতি, চাঁদাবাজিসহ নৌ-অঞ্চলের সকল অপরাধ দমনে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন মোল্যা নজরুল ইসলাম।
২০২২ সালের জুনে উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) হিসেবে পদোন্নতি পাওয়ায় সম্প্রতি মোল্যা নজরুল ইসলামকে রাজধানীর সন্নিকটে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মহানগরী হিসেবে পরিচিত গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনারের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। মহানগরীর মানুষ যেন মাদক, সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজমুক্ত পরিবেশে ঘুমাতে পারেন- সেই প্রত্যয়ে নতুন উদ্যমে কাজ শুরুর প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছেন তিনি। আর এ কাজে রাজনৈতিক নেতৃত্ব, গণমাধ্যমকর্মী ও সুধীসমাজের পরামর্শ ও সহাযোগিতাও কামনা করেছেন।
বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে নানা সামাজিক-সাংষ্কৃতিক সংগঠনের নেতৃত্ব দেওয়া মোল্যা নজরুল ইসলাম ইউএসএ, অষ্ট্রেলিয়া, ভারত, ইংল্যান্ড, নেদারল্যান্ড, ইতালি, ভিয়েতনাম, দক্ষিণ কোরিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অপরাধ দমনের উপর উচ্চতর প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। অর্থনৈতিক অপরাধ উন্মোচনের পাশাপাশি স্পেশাল ক্রাইম ডিটেকশনে তার বিশেষ দক্ষতা রয়েছে।
ব্যক্তিগত জীবনে বিবাহিত মোল্যা নজরুল ইসলাম এঁর সহধর্মিনী শারমিন আক্তার বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন যুগ্ম-পরিচালক। এ সুখী দম্পতি দুই পুত্র সন্তানের গর্বিত পিতা-মাতা।