গণবাণী ডট কম:
গাজীপুর মহানগরীর গাছা থানাধীন বড়বাড়ির বগারটেক এলাকার সড়কের পাশে দাড়ানো নিজ প্রাইভেট কারের ভেতর থেকে শিক্ষক দম্পতির মরদেহ উদ্ধারের প্রায় ৩৮ ঘন্টা পর থানায় হত্যা মামলা রুজু হয়েছে। শুক্রবার রাতে নিহতের ভাই আতিকুর রহমান বাদী হয়ে হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। মামলায় অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামী করা হয়েছে।
বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন জিএমপির উপ পুলিশ কমিশনার (অপরাধ-দক্ষিণ) মোহাম্মদ ইলতুৎমিশ।
গত বৃহস্পতিবার ভোরে গাজীপুর মহানগরীর গাছা থানার বড়বাড়ির বগারটেক এলাকার সড়কের পাশে দাড়ানো নিজ প্রাইভেট কারের ভেতর থেকে গাড়ীতে বসা অবস্থায় এক শিক্ষক দম্পতির মরদেহ তাদের স্বজনেরা উদ্ধার করেন।
এ ঘটনাকে ঐ দম্পতির স্বজনরা পরিকল্পিত হত্যাকান্ড দাবী করছেন। তারা বলছেন, গাড়ীতে তাদের সাথে থাকা কোন কিছুই খোয়া যায়নি। শুধু তাদের মৃত্যু হয়েছে। স্বজনরা সুস্ঠু তদন্ত করে এ বিচার দাবী করেন। এ ঘটনার পর ৩৮ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও পুলিশ এখনও এই মৃত্যুর রহস্যজট খুলতে পারেনি। তবে, পুলিশ দাবী করছে, পুলিশের একাধিক টিম এ জন্য কাজ করছে।
মৃত্যুবরণকারীরা হলেন, এ কে এম জিয়াউর রহমান মামুন (৫১)। ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশাল থানার দড়ি কাঁঠাল গ্রামের মৃত হাবিবুর রহমানের ছেলে। তিনি টঙ্গীর শহীদ স্মৃতি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। তাঁর স্ত্রী মোসা: মাহমুদা আক্তার জলি (৩৫)। আমজাদ আলী সরকার বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষীকা হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তারা গাজীপুর মহানগরীর ৩৬ নং ওয়ার্ডের গাছা থানাধীন কামারজুরি এলাকায় বসবাস করতেন।
শিক্ষক জিয়াউর রহমান মামুনের ভাই ও মামলার বাদি আতিকুর রহমান জানান, তার ভাই স্ত্রীকে গাজীপুর মহানগরীর গাছা থানার কামারজুরি এলাকার নিজ বাড়িতে সপরিবারে বসবাস করতেন। জিয়াউর রহমান মামুনের গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার দড়ি কাঁঠাল এলাকায়। জিয়াউর রহমান ও তার স্ত্রী জলি টঙ্গীর পৃথক স্কুলে চাকুরি করলেও তারা প্রতিদিন একসঙ্গে নিজস্ব প্রাইভেটকারে স্কুলে যাওয়া আসা করতেন। বুধবার (১৭ আগস্ট) স্কুলের কাজ শেষে বিকেল সাড়ে ৬টার দিকে মামাতো ভাইকে গাড়িতে তুলে জিয়াউর নিজে গাড়ি চালিয়ে স্ত্রী জলির স্কুলে যায়। সেখান থেকে জলিকে গাড়িতে তুলে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হন তিনি। পথে মামাতো ভাইকে রাস্তায় নামিয়ে দেন তারা। জিয়াউর রহমানের ছেলে এ কে এম তৌসিফুর রহমান মিরাজ সন্ধ্যা পৌনে সাতটার দিকে তার বাবার মোবাইলে ফোন দেন। কিন্তু বাবার ফোন রিসিভ না হওয়ায় তার মায়ের ফোনে ফোন দিচ্ছিলেন। পরে মা ফোন ধরে বাসায় আসার কথা জানিয়ে বলেন ‘আমরা পথে আছি, কিছুক্ষণের মধ্যে বাসায় আসছি। কিন্তু তাঁরা আর রাতে বাসায় ফেরেননি। আমরা অনেক খোঁজাখুঁজি করেও তাঁদের সন্ধান পাইনি। পরে বৃহস্পতিবার ভোর ৫টার দিকে বাসায় ফেরার পথে গাছা থানাধীন বড়বাড়ী জয়বাংলা সড়কের বগারটেক এলাকায় নিজ প্রাইভেট কারের ভেতরে স্টিয়ারিংয়ে প্রধান শিক্ষক ও পাশে তাঁর স্ত্রীকে নিস্তেজ অবস্থায় পাই। পরে তাৎক্ষণিকভাবে তাঁদের গাড়ি থেকে বের করে প্রথমে তায়রুন্নেছা হাসপাতাল ও পরে উত্তরা নস্ট্রামস হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাঁদের মৃত ঘোষণা করেন।
তিনি আরো জানান, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় গাজীপুর শহীদ তাজউদ্দিন আহমেদ মেডিকেল কলেজের মর্গে ময়না তদন্ত শেষে প্রথমে টঙ্গীতে তাদের বিদ্যালয়ে জানাজার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। পরে তৃতীয় দফা জানাজার নামাজ শেষে ময়মনসিংহের ত্রিশালে রাত আডাইটায় পারিবারীক কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে।
ঐ দম্পতির ছেলে তৌসিফুর রহমান মিরাজ জানান, মোবাইলে কথা বলার সময় মায়ের কথাবার্তায় ক্লান্তির ভাব বুঝতে পারি। এর দীর্ঘক্ষণ পরও বাসায় না আসায় আমি পুনঃরায় ফোন করি। কিন্তু রিং বাজলেও বাবা-মা কেউ ফোন রিসিভ করেননি। এরপর একাধিকবার ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেও পাওয়া যায় নি। এ দম্পতির হদিস না পেয়ে স্বজনেরা রাতভর বিভিন্ন স্থানে খোঁজাখুঁজি করতে থাকেন। তারা গাছা থানা, টঙ্গী পূর্ব, পশ্চিম থানা এবং পূবাইল থানায়ও যোগাযোগ করেন। বড় চাচা ও ফুপাকে সঙ্গে নিয়ে আমরা পূবাইল থানায় খোঁজ করে ভোর সাড়ে ৫টার দিকে ফিরছিলাম। পথে বাড়ির কাছে গাছা থানাধীন বড়বাড়ির বগারটেক এলাকায় হারবাইদ-বড়বাড়ি সড়কের পাশে জিয়াউর রহমানের প্রাইভেটকারটি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি। আমরা গাড়ির কাছে এগিয়ে গিয়ে চালকের সিটে বাবা এবং তার পাশের সিটে (সামনে) মায়ের শীতল ও নিথর দেহ দেখতে পাই। আমরা তাদেরকে উদ্ধার করে প্রথমে স্থানীয় বোর্ড বাজারে তায়েরুন্নেছা মেমোরিয়াল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাই। পরে সেখান থেকে উত্তরার নস্ট্রাম হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাদের মৃত ঘোষণা করেন। এরপর দুটি অ্যাম্বুলেন্সে করে তাদের লাশ গাছা থানায় আনা হয়।
নিহতের বড় ভাই রিপন ও শ্যালীকা আহমিদা আক্তার লিমা বলেন, উত্তরা হাসপাতালের চিকিৎসক তাদের জানিয়েছেন, মরদেহের গলায় কালো দাগ রয়েছে। তাদের মুখ দিয়ে লালা ঝরছিল। এটি একটি পরিকল্পিত হত্যাকান্ডের ঘটনা। তাদের সঙ্গে থাকা স্বর্ণলংকার, নগদ প্রায় দুই লাখ টাকা ও মোবাইল ফোন কিছুই নেয়নি হত্যাকারীরা। ঘটনাটি যদি পরিকল্পিত না-ই হতো তাহলে টাকা, স্বর্ণ, মোবাইল ও গাড়ি নিয়ে যেতো। অথচ তাদের কিছুই তারা নেয়নি। শুধু দুইজনের জীবন নিয়ে গেছে।
জিএমপির গাছা জোনের সহকারি পুলিশ কমিশনার মাকসুদুর রহমান বলেন, ঘটনাস্থল থেকে কয়েকটি সিটিটিভির ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছে। এগুলো পর্যালোচনা করা হচ্ছে আরো সিসিটিভি আশপাশে আছে কিনা সেগুলো সংগ্রহ করার চেষ্টা করা হচ্ছে। ঘটনার কারণ উদঘাটনে পুলিশের একাধিক টিম কাজ করছে। বিষয়টি তদন্তাধীন রয়েছে।
মরদেহের সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করা পুলিশ কর্মকর্তা নাদিউজ্জামান বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে মনে হচ্ছে এটি হত্যাকাণ্ড। ভিসেরা পরীক্ষার জন্য অপরাধ তদন্ত বিভাগে (সিআইডি) পাঠানো হবে। প্রতিবেদন পেলে বিস্তারিত বলা যাবে।’ তিনি জানান, তাঁদের ব্যবহার করা গাড়িটিও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে। তবে এরই মধ্যে তদন্তকাজ চলছে। সন্দেহভাজন কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। মরদেহ উদ্ধার করা প্রাইভেট কারটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন সিআইডির সদস্যরা। তারা প্রাইভেটকার থেকে খাবারের একটি বাটি, কিছু খাবার, ব্যানিটি ব্যাগ ইত্যাদি উদ্ধার করেছেন। পরে এসব জিনিস থানায় হস্তান্তর করা হয়েছে।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় শিক্ষক দম্পতির মরদেহের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়েছে। ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করা গাজীপুর শহীদ তাজউদ্দীন আহমেদ মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান চিকিৎসক শাফি মোহাইমেন বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে এটি হত্যাকাণ্ড বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। তিনি বলেন, ওই দম্পতির মরদেহের ফুসফুস ও কিডনীতে জমাটবাঁধা রক্তের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। বিষক্রিয়া বা অন্য কোনো কারণেও তা হতে পারে। মৃত্যুর প্রকৃত কারণ নির্ণয় করতে রাসায়নিক পরীক্ষার জন্য ঢাকার সিআইডি ল্যাবে নমুনা পাঠানো হয়েছে। ওই প্রতিবেদন পাওয়ার পর মৃত্যুর প্রকৃত কারণ জানা যাবে।’
জিএমপি‘র পুলিশের উপ-কমিশনার (অপরাধ) মোহাম্মদ ইলতুৎমিশ বলেন, ঘটনার পর পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। এ ঘটনায় শুক্রবার সন্ধ্যার পর পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ দেওয়া হয়। পরে এ বিষয়ে একটি হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে। মামলার বাদি নিহতের ভাই আতিকুর রহমান। মামলায় অজ্ঞাত ব্যক্তিদের আসামী করা হয়েছে। ঘটনার রহস্য উদঘাটনে পুলিশের একাধিক টিম সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে কাজ করছে।
জিএমপি‘র অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘বুধবার গাজীপুর মহানগরীর টঙ্গী এলাকার শহীদ স্মৃতি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও তাঁর স্ত্রী স্কুল শেষে মহানগরীর গাছা এলাকায় নিজ বাসার উদ্দেশে রওনা হন। কিন্তু তাঁরা আর রাতে বাসায় ফেরেননি। স্বজনেরা অনেক খোঁজাখুঁজি করেও তাঁদের সন্ধান পাননি। বৃহস্পতিবার ভোর ৫টার দিকে বাসায় ফেরার পথে গাছা থানাধীন বড়বাড়ী জয়বাংলা সড়কের বগারটেক এলাকায় স্বজনেরা নিজ প্রাইভেট কারের ভেতরে স্টিয়ারিংয়ে প্রধান শিক্ষক ও পাশে তাঁর স্ত্রীকে নিস্তেজ অবস্থায় পায়। পরে তাৎক্ষণিকভাবে তাঁদের গাড়ি থেকে বের করে উত্তরা নস্ট্রামস হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাঁদের মৃত ঘোষণা করেন।’
তিনি আরো বলেন, মরদেহের সুরতহাল রিপোর্ট, ময়মনতদন্ত সম্পন্ন হয়েছে। ঢাকা থেকে রাসায়নিক প্রতিবেদন পেলে মৃত্যুর কারণ জানা যাবে। ঘটনাটি তদন্তে ইতিমধ্যে কাজ শুরু করা হয়েছে। বিষয়টি পরিকল্পিত হত্যাকান্ড কিনা তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।