গণবাণী ডট কম:
গাজীপুরের শ্রীপুরের বনখড়িয়া এলাকায় রেল লাইন কেটে নাশকতার করার ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেফতার ৭ আসামীর মধ্যে ৩ আসামী আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্ধী দিয়েছে। বাকী ৪ আসামীর ৩ দিন করে পুলিশ রিমান্ড মঞ্জুর করা হয়েছে।
রোববার রাত ১১টার দিকে এসব বিষয় নিশ্চিত করেছেন মামলার তদন্তকারী সংস্থা গাজীপুরের পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) এর পুলিশ সুপার মো: মাকসুদের রহমান।
তিনি আরো জানান, শনিবার রাতে আসামীদের গ্রেফতারের পর রোববার বিকালে ৭ আসামীদের সকলকে ঢাকা জেলার চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করা হয়। সেখানে তাদের মধ্যে ৩ জন আসামী বিজ্ঞ আদালতে স্বেচ্ছায় জবানবন্ধী দিতে রাজী হন। পরে ঢাকার চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক তাদের ৩ জনের জবানবন্ধী লিপিবদ্ধ (রেকর্ড) করেন। একই সময়ে ঢাকার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত-৫ এর বিচারক মো: জুলহাস শুনানী শেষে বাকী ৪ আসামীর ৩ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন।
গাজীপুর মহানগর পুলিশের উপ পুলিশ কমিশনার (মিডিয়া) ইব্রাহিম খান জানান, ঢাকার চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক শেখ মোজাহেদুল ইসলাম ও মো: মোস্তাফিজুর রহমান স্বীকারোক্তি দেওয়া ৩ আসামীর জবানবন্ধী লিপিবদ্ধ (রেকর্ড) করেন।
তিনি আরো জানান, স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্ধী দেওয়া আসামীরা হলো, গাজীপুর মহানগরীর সদর থানাধীন উত্তর ছায়াবিথী এলাকার মৃত সোলায়মান মোড়লের ছেলে শাহানুর আলম (৫০), নেত্রকোনা জেলার মদন থানার বারই বাজার এলাকার রফিকুল ইসলামের ছেলে (বর্তমানে গাজীপুর মহানগরীর সদর থানাধীন ২৮ নং ওয়ার্ডের ভাড়াটিয়া) জান্নাতুল ইসলাম (২০),ময়মনসিংহ জেলার ভালুকা থানাধীন বান্দীয়া গ্রামের তাইজুদ্দীনের ছেলে মেহেদী হাসান (২৫)।
এছাড়া যে ৪ আসামীর ৩ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করা হয়েছে, তারা হলো, গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ২৮নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও মৃত বিল্লাল হোসেন ভূঁইয়ার ছেলে আজমল হোসেন ভূঁইয়া (৫০), গাজীপুর মহানগরীর সদর থানাধীন ভানোয়া ২৪নং ওয়ার্ডের পিতা-তারিকুল ইসলাম দিপুর ছেলে জুলকার নাইন আশরাফি ওরফে হৃদয় (৩৫), গাজীপুর মহানগরীর সদর থানাধীন কানাইয়া পূর্বপাড়া এলাকার মৃত ওমেদ আলী মোল্লার ছেলে মোঃ সাইদুল ইসলাম (৩২) ও গাজীপুর মহানগরীর সদর থানাধীন মধ্য ছায়াবিধি, ২৮নং ওয়ার্ডের আফতাফ উদ্দিনের ছেলে সোহেল রানা (৩৮)।
এর আগে রেল লাইন কেটে নাশকতার করার ঘটনায় জড়িত গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ২৮নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর আজমল হোসেন ভূঁইয়াসহ সাত আসামীকে শনিবার রাতে গ্রেফতার করে পুলিশ।
রোববার বেলা ১২টায় গাজীপুর মহানগর পুলিশ কমিশনার কার্যালয়ে মহানগর পুলিশ কমিশনার মাহবুব আলম সংবাদ সম্মেলনে নাশকতার উদ্দেশ্য, কারা কিভাবে ঘটনা ঘটিয়েছে এসব বিষয়ে বিস্তারিত অবহিত করেন।
পুলিশ কমিশনার মাহবুব আলম বলেন, গ্রেফতারের পর আটককৃত ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদ করলে তারা জানায়, ১১ ডিসেম্বর রাতে সাবেক বিএনপি নেতা আজমল ভূঁইয়ার বাসাসহ বিভিন্নস্থানে মিটিং হয়। উক্ত মিটিং এ রেল লাইন কেটে নাশকতা ঘটানোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত এবং পরিকল্পনা করা হয়। উক্ত মিটিং এ আলোচনা হয় , দলীয় উচ্চ পর্যায় থেকে বড় কিছু করার চাপ আছে: বড় কোন ঘটনা ঘটলে দেশ ও বিদেশে আলোড়ন সৃষ্টি হবে বিধায় তারা রেল লাইনে নাশকতা ঘটানোর পরিকল্পনা করে। সরকার এর বর্তমান নির্বাচনী কার্যক্রমকে বিতর্কিত করা, আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বর্তমানে বিরাজমান রাষ্ট্রীয় সু-শৃংখল পরিবেশকে নষ্ট করা, জনমনে ভীতি সঞ্চার করা এবং এর মাধ্যমে দেশ ও বিদেশে ব্যপক মিডিয়া কাভারেজ, হরতাল-অবরোধ সফল করার জন্য ব্যাপক প্রাণহানির ও ধ্বংসযজ্ঞের জন্য রেললাইনকে বেছে নেয়া হয়েছিল যা দেশ ও বিদেশে আলোড়ন তৈরি করতে পারে।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে জিএমপি কমিশনার বলেন, মামলা তদন্ত করতে গিয়ে আমরা জানতে পারি যে, একদল দুষ্কৃতিকারী ১৩ ডিসেম্বর ভোর আনুমানিক ৩টা থেকে ৪টার মধ্যে গাজীপুর জেলাধীন শ্রীপুর উপজেলার প্রহলাদপুর ইউনিয়নের বনঘরিয়া চিনাই রেল ব্রীজের পাশে রেল লাইন কেটে ফেলে। ফলশ্রুতিতে মোহনগঞ্জ-ঢাকাগামী “মোহনার এক্সপ্রেস” দুর্ঘটনার কবলে পড়ে। এতে ট্রেনটির ইঞ্জিনসহ সাতটি বগি লাইনচ্যুত হয়। উক্ত দুর্ঘটনায় ঘটনাস্থলে একজন নিহত হয় এবং ১০ জন হয়।
তিনি বলেন, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে এবং তথ্য প্রযুক্তি বিশ্লেষণের মাধ্যমে আমরা শনিবার দুঃষ্কৃতিকারী দলের সদস্য জান্নাতুল ইসলাম ও মেহেদী হাসানকে আটক করা হয়। পরে ধৃত জান্নাতুল ইসলাম এবং মেহেদী হাসানকে জিজ্ঞাসাবাদে করলে তারা উক্ত ঘটনার সাথে সরাসরি জড়িত গাজীপুর মহানগর ছাত্রদলের সাংগঠনিক সম্পাদক মাসুম , কাজী আজিমুদ্দিন কলেজ শাখা ছাত্রদলের আহবায়ক ত্বোহাসহ মোট ৮ আট জন জড়িত আছে মর্মে জানায়। তাদের দেয়া তথ্য মতে এই ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারী ও অর্থদাতা মোঃ হাসান আজমল ভূঁইয়া, জুলকার নাইন আশরাফি ওরফে হৃদয়, শাহানুর আলম, মোঃ সাইদুল ইসলাম, সোহেল রানাসহ অন্যদেরকে গ্রেফতার করা হয়।
তিনি আরো বলেন, উক্ত নাশকতার পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়ন কারী সদস্যরা সকলেই বিএনপি এবং তার বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের নেতা এবং সক্রিয় সদস্য।
পুলিশ কমিশনার বলেন, জিজ্ঞাসাবাদে আসামীরা জানায়, উক্ত ঘটনা ঘটাবার উদ্দেশ্যে তারা গাজীপুর মহানগরীর কোনাবাড়ী থেকে একটি মাইক্রোবাস গত ১২ ডিসেম্বর সন্ধ্যার পরে ঢাকা যাওয়ার কথা বলে ভাড়া করে। তারা ভাড়া করা গাড়ী নিয়ে ঢাকা যাওয়ার কথা থাকলেও ঢাকায় না গিয়ে গাজীপুরের বিভিন্ন জায়গায় ঘোরাফেরা করতে থাকে। পরে ভাড়াকৃত গাড়ী নিয়ে তারা রেল লাইন কেটে নাশকতা ঘটানোর উদ্দেশ্যে বের হয়। পথিমধ্যে তারা শিববাড়ী, জোড় পুকুরপাড় সহ আরো বিভিন্ন স্থান থেকে বেশ কয়েকজনকে গাড়ীতে উঠায়। এসময় সকলের মুখোশ পরা অবস্থায় ছিলো। এ কারণে চালক ভয় পেয়ে ঢাকায় না যাওয়া এবং মুখোশ পরার কারণ জিজ্ঞেস করলে তাদের মধ্যে একজন মুখোশ খোলে ড্রাইভারকে তার চেহারা দেখায় এবং বলে, “দেখো আমাকে তুমি চিনে কিনা?” তারপর ড্রাইভার তাকে চিনতে পেরে আর কিছু বলে না।
তিনি আরো জানান, পরে আসামীরা গাজীপুর মহানগরীর সদর থানাধীন জোর পুকুরপাড়হ ইবনে সিনহা তোহার বাড়ীর সামনে থেকে, রেল লাইন কাটার যন্ত্রপাতি ও বাশ বাগান রেষ্টুরেন্ট থেকে দুইটি গ্যাস সিলিন্ডার তুলে। পরে তারা বিভিন্ন এলাকা ঘুরে সময় ক্ষেপন করে। রাত ১০টার দিকে তারা শিমুলতলীতে হান্ডি রেষ্টুরেন্ট খাবার খায়। পরে তারা রাত ১১টার দিকে শহরের ভিতরে বিভিন্ন অলি গলিতে ঘোরাঘুরি করে আনুমানিক রাত সাড়ে ১২টার দিকে তারা বনমরিয়া এলাকায় ঘটনাস্থল থেকে ৪-৫ কিলোমিটার দূরত্বে বনের পাশে গাড়ী রেখে পায়ে হেঁটে তারা গ্যাস সিলিন্ডারসহ সরঞ্জমালী নিয়ে বনমরিয়া চিনাই রেল ব্রীজের পাশে যায়। সেখানে গিয়ে তারা একত্রে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষন করে এবং সুযোগ বুঝে আনুমানিক ভোর ৩টা থেকে ৪টার মধ্যে আসামীরা ২০ ফিট রেল লাইন কেটে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। পরে ভোর আনুমানিক সোয়া ৪টার দিকে মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনটি ঘটনাস্থলে পৌঁছালে দুর্ঘটনার শিকার হয়।
তিনি আরো বলেন, রেল লাইন কেটে আসামীরা গাড়ী নিয়ে ঢাকায় চলে যায়। ঢাকায় গিয়ে আসামীদের কয়েকজন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কাছে নেমে যায় এবং বাকীরা মিরপুরে গিয়ে নামে।
তিনি জানান, এই ঘটনার কাজে ব্যবহৃত মাইক্রোবাস উদ্ধার করা হয়েছে। মাইক্রোবাসের চালক ঘটনার সাথে সরাসরি প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী হিসেবে ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছে এবং নাশকতার কাজে ব্যবহৃত গ্যাস সিলিন্ডার ও অন্যান্য জিনিসপত্র উদ্ধার করা হয়েছে এবং এর প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষীও পাওয়া গেছে।
সাংবাদিক সম্মেলনে আরো উপস্থিত ছিলেন, গাজীপুরের জেলা প্রশাসক আবুল ফাতে মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম, জেলা পুলিশ সুপার কাজী শফিকুল আলম, পিবিআ্ই এর মো: মাকসুদের রহমানসহ জিএমপির উর্ধ্বতন কর্মকর্তাগণ।
উল্লেখ্য, গাজীপুরের শ্রীপুরে উপজেলাধীন ভাওয়াল গাজীপুর ও রাজেন্দ্রপুর রেলওয়ে স্টেশনের মধ্যবর্তী বনখড়িয়া এলাকায় চিলাই ব্রিজের কাছে রেললাইন কেটে ফেলায় ১৩ ডিসেম্বর (গত বুধবার) ভোর ৪টার দিকে নেত্রকোণার মোহনগঞ্জ থেকে ঢাকাগামী মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনের ইঞ্জিনসহ সাতটি বগি লাইনচ্যুত হয়। এতে ট্রেনের এক যাত্রী আসলাম মিয়া নিহত ও লোকো মাস্টারসহ ১০ কয়েকজন গুরুতর আহত হন। এই ঘটনায় কমলাপুর রেলওয়ে থানায় বৃহস্পতিবার মামলা হয়। ঘটনা তদন্তে গাজীপুর জেলা প্রশাসন, রেলওয়ে এবং রেলপথ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে আলাদা তিনটি কমিটি করা হয়েছে।