নিজস্ব প্রতিবেদক (কাপাসিয়া) গাজীপুর:
গাজীপুরের কাপাসিয়াতে নিজ ঘরে হাত-পা বেঁধে শ্বাসরোধে প্রবাসীর স্ত্রীকে হত্যার রহস্য উদঘাটন করেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। ঋণগ্রস্থ ভাই ঋণের টাকা পরিশোধ করতে না পেরে আপন বোনের ঘরে চুরি করার পরিকল্পনা এঁটে বন্ধুকে নিয়ে করে ঢুকে। কিন্তু, চিনে ফেলায় ও বোন চিৎকার শুরু করলে তার হাত-পা বেঁধে শ্বাসরোধে হত্যা করে ঘরের টাকা ও স্বর্ণালংকার লুট করে নেয় তারা।
এ ঘটনায় জড়িত নিহতের আপন ছোট ভাই ও তার বন্ধুকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গ্রেফতারের পর আসামীরা শুক্রবার বিজ্ঞ আদালতে নিজের দোষ স্বীকার করে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্ধি দিয়েছে।
শুক্রবার (৫ এপ্রিল) দুপুরে গাজীপুর পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)’র পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মাকছুদের রহমান বিপিএম এসব তথ্য জানিয়েছেন।
তিনি জানান, গত মঙ্গলবার (২এপ্রিল) সকাল সাড়ে ৮টার দিকে কাপাসিয়া উপজেলার সিংহশ্রী ইউনিয়নের পূর্ব ভিটিপাড়া গ্রামের দক্ষিণ কোরিয়া প্রবাসী মোঃ মোশারফ হোসেনের স্ত্রী শাহনাজ বেগম শিমু (৩৯) এর মরদেহ নিজ বসত ঘরের ভেতর থেকে উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় নিহতের বাবা মো: সিরাজ উদ্দিন বেপারী বাদী হয়ে কাপাসিয়া থানায় অজ্ঞাত আসামীদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন।
তিনি আরো জানান, মরদেহ উদ্ধারের পরপরই কাপাসিয়া থানা পুলিশের পাশাপাশি গাজীপুর পিবিআই’র একাধিক টিম মামলাটির রহস্য উদঘাটনে ছায়া তদন্তে নামে। গোয়েন্দা তথ্য ও আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার করে হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত মূল আসামী মোঃ কামরুজ্জামান রুবেলকে বৃহস্পতিবার (৪ এপ্রিল) বিকেলে গাজীপুর মহানগরীর গাছা থানা এলাকা হতে ও পরে তার দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে একই দিন তার বন্ধু মোঃ মিনাল ওরফে মিষ্টারকে ঢাকার উত্তরা পশ্চিম থানা এলাকা থেকে একই দিন গ্রেফতার করা হয়।
গ্রেফতার মোঃ কামরুজ্জামান রুবেল (৩৬) নিহত শাহনাজ বেগম শিমু’র আপন ছোট ভাই এবং মামলার বাদী কাপাসিয়ার কুলগঙ্গা গ্রামের মো: সিরাজ উদ্দিন বেপারীর ছেলে। অপরজন মোঃ মিনাল ওরফে মিষ্টার (২১) শেরপুর জেলার শ্রীবর্দী থানার মামদাবাড়ি গ্রামের আস্কর আলীর ছেলে।
গ্রেফতারের পর আসামীরা জানায়, নিহত শিমুর আপন ছোট ভাই রুবেল গাজীপুরে একটি আবাসিক হোটেলে চাকুরী করতো। পাঁচ মাস আগে রুবেল ওই হোটেলের চাকুরী ছেড়ে দিলে অর্থনৈতিক সংকটে পরে, অনেকের কাছ থেকে টাকা ঋণ করে। ঋণে জর্জরিত রুবেল ঋণের টাকা পরিশোধ করতে গিয়ে বোন শিমুর বাসায় চুরির পরিকল্পনা করে এবং দুইদিন আগে অপর আসামী মোঃ মিনাল ওরফে মিষ্টারের সাথে যোগাযোগ করে। পরে তারা উভয়ে বিভিন্ন পথ ঘুরে ঘটনার দিন বিকেলে মিস্টার জয়দেবপুর রেল স্টেশনে আসে। এসময় রুবেল ও মিনাল একটি ব্যাগের মধ্যে একটি সুইচ গিয়ার চাকু, প্লাস, গামছা, কেচি নিয়ে ট্রেনে করে শ্রীপুর স্টেশনে নামে। সেখান থেকে অটোরিক্সা ভাড়া করে বরমী পুরাতন বাস স্ট্যান্ড এলাকায় যায়। সেখানে কিছু সময় অপেক্ষা তারা অটোরিক্সা দিয়ে রাত ৮টার দিকে তারা সেখান থেকে বরামা ব্রিজ এলাকায় যায়, বরামা ব্রিজ পাড় হয়ে পায়ে হেঁটে তারা ভিকটিম শাহনাজ আক্তার শিমুর বাড়ীর সামনে আখ খেতে লুকায়। রাত ১২টার দিকে রুবেল-মিস্টার শিমুর বাড়ীর সীমানা প্রাচীরের উপর দিয়ে বাসার ছাদে উঠে। ছাদ থেকে রান্না ঘরের সিমেন্টের টিন খুলে রান্না ঘরে প্রবেশের চেষ্টা করে। রান্না ঘর থেকে দরজা খুলে বাইরে এসে বাড়ীর পেছনের খোলা জানালায় বাঁশের লাঠি দিয়ে ভেতরের সিটকারী খুলে ঘরের ভেতরে ঢুকে। এসময় তাদের সাড়াশব্দ পেয়ে ঘুম ভাঙ্গলে শিমু চিৎকার শুরু করলে মিনাল সুইচ গিয়ার ছুরি দেখিয়ে ভয় দেখায়, কিন্তু শিমু চিৎকার না থামালে গামছা দিয়ে মিশুর মুখ চেপে ধরে এবং রুবেল শিমু’র হাত দঁড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলে এসময় রুবেলের দুই হাতে শিমুর হাতের নখের আচড় লাগে। রুবেলকে যাতে চিনতে না পারে, সেজন্য শিমুর চোখ, মুখ, গামছা দিয়ে বেঁধে ফেললে শিমুর মিনালের সাথে ধস্তাধস্তি শুরু করলে আসামী মিষ্টার শিমুর মুখে আঘাত করে এবং শিমুর বুকের উপর বসে গলায় চেপে ধরে। এরপর আসামী রুবেল টেবিলের ড্রয়ার থেকে চাবি নিয়ে আলমারি খুলে স্বর্ণালংকার ও তিন হাজার টাকা, শিমুর মোবাইল ফোন নিয়ে নিয়ে রুবেল ও মিষ্টার ভিকটিম শিমু’র হাত ও পা বেঁধে বাড়ির পকেট গেট দিয়ে বের হয়ে চলে যায়। পরদিন সকালে রুবেল চাকু, প্লাস ও মোবাইল সেট ভেঙ্গে ঝাজর এলাকায় ব্রিজের নিচে খালের পানিতে ফেলে দেয় এবং লুন্ঠিত স্বর্ণালংকার দেড় লাখ টাকা বিক্রি করে। রুবেলকে গ্রেফতারের পর স্বর্ণ বিক্রির ৫৭হাজার টাকা উদ্ধার ও তার দেয়া তথ্যমতে গাজীপুর মহানগরের ঝাজর কবরস্থান ব্রীজের নীচে খাল থেকে প্লাস, সুইচ গিয়ার চাকু ও চোরাইকৃত মোবাইল সেটের খন্ডিত অংশ উদ্ধার করা হয়েছে।
তিনি আরো জানান, আসামী রুবেলকে জিএমপি গাছা থানা এলাকা থেকে গ্রেফতারের পর তার নিকট থেকে স্বর্ণ বিক্রির ৫৭ হাজার টাকা এবং হত্যাকান্ডে ব্যবহৃত সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়। তার দেয়া তথ্যমতে উত্তরা পশ্চিম থানা এলাকা থেকে অপর আসামী মিনাল ওরফে মিষ্টারকে গ্রেফতার করা হয়।
পিবিআই পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মাকছুদের রহমান বলেন, রুবেল ও শিমু সম্পর্কে আপন ভাই—বোন। আবাসিক হোটেলের চাকুরি ছাড়ার পর থেকে রুবেল আর্থিক সংকটে পড়ে ঋণগ্রস্থ হয়ে যান এবং সবজি বিক্রেতা মিষ্টারকে নিয়ে নিজ বোনের স্বর্ণালংকার ও টাকা লুট করেন। আসামীরা প্রথমে লুটের উদ্দেশ্যে গেলেও যখন দেখলেন বোন শিমুকে বাঁচিয়ে রাখলে সমস্যা হতে পারে, তখন তারা তাকে শ্বাসরোধ করে মেরে ফেলে।
পিবিআই’র পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মাকছুদের রহমান বিপিএম বলেন, নিহতের ভাই রুবেল ও মিস্টার স্বেচ্ছায় আদালতে স্বীকারোক্তিমুলক জবানবন্ধি দিয়েছে। স্বর্ণ বিক্রির অবশিষ্ট টাকা ও স্বর্ণ উদ্ধারে অভিযান চলছে।