গণবাণী ডট কম:
অধিকৃত পশ্চিম তীরের কিছু অংশ ইসরায়েলের অন্তর্ভূক্ত করার পরিকল্পনার কড়া প্রতিবাদ জানিয়ে লেখা একটি চিঠিতে সই করেছে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে এক হাজারের বেশি সংসদ সদস্য।
চিঠিতে এই প্রস্তাব সম্পর্কে “গভীর উদ্বেগ” প্রকাশ করা হয়েছে এবং এর “অবশ্যম্ভাবী পরিণতি”র কথা বলা হয়েছে। এদের মধ্যে ব্রিটেনের ২৪০জন এমপি রয়েছেন।
এই অন্তর্ভূক্তি প্রক্রিয়া শুরু হতে পারে আগামী সপ্তাহে। তার আগে এই চিঠি বেশ কিছু সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে।
যে ক্ষমতা ভাগাভাগির চুক্তিতে গত মাসে ইসরায়েলের বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করে, সেই চুক্তি অনুযায়ী পয়লা জুলাই থেকে এই অন্তর্ভূক্তির বিষয়টি নিয়ে ভোটাভুটি হবার কথা।
এই প্রকল্পে নেতৃত্ব দিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী বিনিয়ামিন নেতানিয়াহু। তিনি পশ্চিম তীরের বেশ কিছু এলাকা যেখানে ইহুদী বসতি রয়েছে, সেসব এলাকার ওপর ইসরায়েলের সার্বভৌমত্ব বিস্তার করতে চান।
এই বিল যদি পাশ হয়, তাহলে পশ্চিম তীরের ৩০% ইসরায়েলের অন্তর্ভূক্ত হবে। ফিলিস্তিনিরা দাবি করছে, ভবিষ্যতে তারা তাদের নিজস্ব যে স্বাধীন রাষ্ট্র চাইছে এই ভূমি তারই অংশ হবে।
এই অংশ ইসরায়েলের অন্তর্ভূক্ত করার বিষয়টিকে সবুজ সঙ্কেত দিয়েছিলেন আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। কয়েক দশক ধরে চলা ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত অবসানে জানুয়ারি মাসে মি. ট্রাম্প শান্তি পরিকল্পনা নিয়ে তার প্রস্তাবে সমাধানের এই ফর্মূলা দেন।
‘শান্তির সম্ভাবনার মৃত্যু’
ইউরোপের দেশগুলোর পররাষ্ট্র মন্ত্রীদের কাছে লেখা এই চিঠিতে হুঁশিয়ার করে দেয়া হয়েছে যে, পশ্চিম তীরের এসব অংশ একপাক্ষিক সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে ইসরায়েলের অন্তর্ভূক্ত করা হলে তাতে “ইসরায়েল-ফিলিস্তিন শান্তির সম্ভাবনার মৃত্যু ঘটবে এবং তা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের মূল যে ভিত্তিগুলো এটা তার জন্য বড় একটা চ্যালেঞ্জ হবে “।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের শান্তি প্রস্তাবের ফলশ্রুতিতে নেয়া ইসরায়েলের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে চাপ বাড়ছে বলে জানাচ্ছেন জেরুসালেমে বিবিসির সংবাদদাতা টম বেটম্যান।
কী আছে চিঠিতে?
এই চিঠির উদ্যোক্তা ইসরায়েলী পার্লামেন্টের সাবেক স্পিকার আব্রাহাম বার্গ এবং ইসরায়েলের আরও তিন ব্যক্তিত্ব যারা পশ্চিম তীরে দুই রাষ্ট্র তত্ত্বের সমর্থক।
এই চিঠির মূল বক্তব্যে বলা হয়েছে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের পরিকল্পনা হল “খন্ডিত ফিলিস্তিনি অঞ্চলে কার্যত ইসরায়েলের স্থায়ী নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা, যেখানে ফিলিস্তিনিদের কোন সার্বভৌমত্ব থাকবে না। এবং পশ্চিম তীরের উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অংশ এর মাধ্যমে একপাক্ষিক ভাবে ইসরায়েল যাতে তার অংশ করে নিতে পারে তার জন্য আমেরিকার সবুজ সঙ্কেত দেয়া।”
এই চিঠিতে স্বাক্ষর করেছেন ২৫টি দেশের যে ১,০৮০জন সাংসদ, তারা হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন যে এই পদক্ষেপ ওই অঞ্চলে একটা “অস্থিতিশীলতার আশংকা” ডেকে আনবে।
তাদের চিঠিতে আরও হুঁশিয়ারি দেয়া হয়েছে যে এই অন্তর্ভূক্তি যদি “বিনা চ্যালেঞ্জে” পাশ হয়ে যায় তাহলে “আন্তর্জাতিক আইনের মূল নীতিকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে অন্যান্য দেশও তাদের আঞ্চলিক সার্বভৌমত্বের দাবি নিয়ে এগিয়ে যেতে উৎসাহিত হবে”। তারা স্পষ্ট করে না বললেও এমন ইঙ্গিত দিয়েছেন যে ইসরায়েল এই পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করলে এটা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর্যায়ে পড়ে।
বিশ্লেষকরা বলছেন মি. নেতানিয়াহু নভেম্বরে আমেরিকার আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগেই তড়িঘড়ি করে এই পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করতে চাইছেন। কারণ মি. ট্রাম্প যদি নির্বাচনে হেরে যান এবং তার প্রতিদ্বন্দ্বী জো বাইডেন ক্ষমতায় আসেন তাহলে এ ব্যাপারে আমেরিকান নীতি হয়ত বদলে যেতে পারে, কারণ মি. বাইডেন এই অন্তর্ভূক্তির বিপক্ষে।
ব্রিটেনের যেসব এমপি এই চিঠিতে স্বাক্ষর করেছেন তাদের মধ্যে কনজারভেটিভ ও লেবার পার্টির বেশ কয়েকজন প্রথম সারির সংসদ সদস্য রয়েছেন। ইউরোপের উল্লেখযোগ্য নামের মধ্যে রয়েছেন ফ্রান্সের নিরাপত্তা সাবকমিটির চেয়ার, নাথালি লয়সু, ইউরোপীয় পার্লামেন্টের ভাইস প্রেসিডেন্ট ফ্যাবিও মাস্সিমো কাস্তালদো এবং আর্য়াল্যান্ডের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী মাইকেল মার্টিন।
পশ্চিম তীর :
জর্ডান নদীর পশ্চিম তীরে এই ভূখণ্ডের উত্তর, পশ্চিম ও দক্ষিণ ঘিরে রয়েছে ইসরায়েল আর পূর্বে জর্ডান।
ইসরায়েল ১৯৬৭র মধ্য প্রাচ্য যুদ্ধের পর থেকে এই পশ্চিম তীর অধিকার করে রেখেছে। কিন্তু কয়েক দশক ধরে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে কঠিন আলাপ আলোচনার পরেও এই অঞ্চলের চূড়ান্ত মালিকানার বিষয়টি আজও নিষ্পত্তি হয়নি।
পশ্চিম তীরে সীমিত স্বশাসন ও ইসরায়েলী সামরিক আইনের অধীনে বসবাস করেন ২১ থেকে ৩০ লাখ (বিভিন্ন সূত্রমতে) ফিলিস্তিনি আরব।
পূর্ব জেরুসালেমের বাইরে পশ্চিম তীরে বাস করেন প্রায় ৪ লাখ ৩০ হাজার ইসরায়েলী ইহুদী। তারা থাকেন ১৩২টি বিভিন্ন বসতিতে, যেগুলো ইসরায়েল দখলদারিত্বের ভিত্তিতে নির্মাণ করেছে।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের একটা বড় অংশ মনে করে এই বসতি আন্তর্জাতিক আইনে অবৈধ। যদিও ইসরায়েল এবং ট্রাম্প প্রশাসনাধীন আমেরিকা এ বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করে।
ইসরায়েল যে অন্তর্ভূক্তি প্রক্রিয়া শুরু করতে চায় তা সফল হলে পশ্চিম তীরের ৪.৫% ফিলিস্তিনি ইসরায়েলের অন্তর্গত অঞ্চলে ছিটমহলের বাসিন্দায় পরিণত হবেন।
ইসরায়েলী পরিকল্পনায় বিশ্বমত কী?
ইসরায়েলের মিত্র ও অ-মিত্র নির্বিশেষে প্রায় প্রত্যেক রাষ্ট্রই ইসরায়েলকে এই পরিকল্পনা নিয়ে এগোতে বারণ করেছে। তাদের আশংকা এই পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করলে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে কোনরকম শান্তির সম্ভাবনা সুদূর পরাহত হয়ে যাবে।
ফিলিস্তিনিরা মি. নেতানিয়াহুার এই পরিকল্পনা বাতিলের জন্য আন্তর্জাতিক মহলের কাছে চাপ সৃষ্টির আহ্বান জানিয়েছে। ফিলিস্তিনী প্রধানমন্ত্রী বলেছেন ইসরায়েল যদি পশ্চিম তীরের ভূখণ্ড তাদের রাষ্ট্রের অন্তর্ভূক্ত করে, তাহলে ফিলিস্তিন পশ্চিম তীরের প্রায় সম্পূর্ণ ভূখণ্ড তাদের স্বাধীন রাষ্ট্র বলে ঘোষণা করতে পারে।
জাতিসংঘের মধ্য প্রাচ্য বিষয়ক দূত সতর্ক করে দিয়েছেন যে ইসরায়েলের এই অন্তর্ভূক্তিকরণ এবং ফিলিস্তিনের পাল্টা পদক্ষেপ “স্থানীয় পরিস্থিতি নাটকীয়ভাবে বদলে দেবে এবং এর ফলে অধিকৃত পশ্চিম তীর এবং গাযা ভূখণ্ডে সংঘাত ও অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করবে”।
তবে ইসরায়েলের নিন্দা করে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষেদে কোন প্রস্তাব পাশের চেষ্টা হলে আমেরিকার তাতে বাধা দেবার সম্ভাবনা রয়েছে।
ইসরায়েলের সাথে শান্তি চুক্তিতে মাত্র যে দুটি আরব দেশ স্বাক্ষর করেছে তার একটি হল জর্ডান। জর্ডান বলছে ইসরায়েল যদি এই অ্যানেকসেশন বা অন্তর্ভূক্তি প্রক্রিয়া কার্যকরে এগোয়, তাহলে জর্ডান ইসরায়েলের সাথে তাদের সম্পর্ক পুর্নবিবেচনা করতে বাধ্য হবে।
আরব দুনিয়া ইসরায়েলের পরিকল্পনার তীব্র সমালোচনা করলেও বিশ্লেষকরা মনে করছেন ফিলিস্তিনের সাথে সংহতি প্রকাশ করার থেকে বেশি কিছু তারা করবে না। বিশেষ করে সেই সব উপসাগরীয় আরব দেশ যাদের সাথে ইসরায়েলের একটা অনানুষ্ঠানিক সম্পর্ক রয়েছে।
ইসরায়েলের সর্ববৃহৎ বাণিজ্যিক পার্টনার হল ইউরোপীয় ইউনিয়ন। তারা বলছে ইসরায়েল যাতে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে না এগোয় তার জন্য তারা কূটনৈতিক পথে ইসরায়েলকে “নিরুৎসাহিত করার চেষ্টা করবে”। যদিও ইইউ-র কোন কোন সদস্য দেশ নিষেধাজ্ঞা আরোপ সহ কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছে। কিন্তু ইসরায়েলের বিরুদ্ধে এতটা কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের পক্ষে এখনও পর্যন্ত ততটা ব্যাপক সমর্থন দেখা যাচ্ছে না। খবর : বিবিসি।