গণবাণী ডট কম:
বিংশ শতকের ব্রিটিশ ভারতের অন্যতম তৃণমূল রাজনীতিবিদ ও গণআন্দোলনের নায়ক কিংবদন্তি রাজনৈতিক নেতা মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর ৪৪তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। তিনি জীবদ্দশায় ১৯৪৭-এ সৃষ্ট পাকিস্তান ও ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। সাহসী ও নিবেদিতপ্রাণ সাধারণ মানুষের এই নেতা তার প্রায় পুরোটা জীবন নির্যাতিত ও নিপীড়িত মানুষের কল্যাণে কাজ করেছেন। পেয়েছিলেন ‘মজলুম জননেতা’ উপাধি। তিনি বাংলাদেশের মানুষের কাছে মজলুম জননেতা” হিসাবে সমধিক পরিচিত।
সাধারণ মানুষের এই নেতা ১৯৭৬ সালের ১৭ নভেম্বর ঢাকার পিজি হাসপাতালে (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়) চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৯৬ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। তাকে টাংগাইল জেলার সদর উপজেলার উত্তর-পশ্চিমে সন্তোষ নামক স্থানে পীর শাহজামান দীঘির পাশে সমাধিস্থ করা হয়। মাওলানা ভাসানী অধিকারবঞ্চিত অবহেলিত মেহনতি মানুষের অধিকার ও স্বার্থরক্ষায় নিরবচ্ছিন্নভাবে সংগ্রাম করে গেছেন। স্বাধীন বাংলাদেশের একজন স্বপ্নদ্রষ্টা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ১৮৮০ সালের ১২ ডিসেম্বর সিরাজগঞ্জের ধানগড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
বিভিন্ন সামাজিক-রাজনৈতিক সংগঠন সারাদেশে নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে দিবসটি উদযাপন করবে। টাঙ্গাইলের সন্তোষে মাওলানা ভাসানীর সমাধিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হবে সংগঠন ও ব্যক্তি পর্যায়ে।
ভাসানী পরিষদ, ভাসানী ফাউন্ডেশন, খোদা-এ-খেদমতগার এবং মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়সহ টাঙ্গাইলের বিভিন্ন সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান এ উপলক্ষে স্বাস্থ্য সংক্রান্ত নির্দেশনা অনুসরণ করে সন্তোষে এই মহান নেতার সমাধিতে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে মাওলানা ভাসানীর সমাধিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ, মিলাদ ও দোয়া মাহফিল, কুরআন খতম, গণভোজ, রক্তদান কর্মসূচী, আলোকচিত্র প্রদর্শনী, আধ্যাত্মিক গান, ভাসানীর জীবন ও কর্মের ওপর আলোচনা সভা ইত্যাদি।
তিনি আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি ছিলেন, যে দলটি পরবর্তী সময়ে নাম বদল করে হয়েছে আওয়ামী লীগ। তিনি ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) নামে একটি বামপন্থী রাজনৈতিক দলও গঠন করেছিলেন। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট গঠনকারী প্রধান নেতাদের মধ্যে তিনি অন্যতম। স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায়ও তিনি বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। রাজনৈতিক জীবনের বেশিরভাগ সময়ই তিনি মাওপন্থী কম্যুনিস্ট, তথা বামধারার রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন।তার অনুসারীদের অনেকে এজন্য তাকে “লাল মওলানা” নামেও ডাকতেন। তিনি কৃষকদের জন্য পূর্ব পাকিস্তান কৃষক পার্টির করা জন্য সারাদেশ ব্যাপী ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেন। তিনি ছিলেন একজন দূরদর্শী নেতা এবং পঞ্চাশের দশকেই নিশ্চিত হয়েছিলেন যে পাকিস্তানের অংশ হিসেবে বাংলাদেশ একটি অচল রাষ্ট্রকাঠামো। ১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দের কাগমারী সম্মেলনে তিনি পাকিস্তানের পশ্চিমা শাসকদের ‘আসসালামুআলাইকুম ‘ বলে সর্বপ্রথম পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতার ঐতিহাসিক ঘণ্টা বাজিয়েছিলেন।
রাজনীতির পাশাপাশি তিনি সমাজ সংস্কারমূলক কর্মকান্ডে জড়িত ছিলেন। জয়পুরহাট-এর পাঁচবিবিতে মহিপুর হক্কুল এবাদ মিশন প্রতিষ্ঠা করেন যার অধীনে একটি মেডিকেল, টেকনিক্যাল স্কুল,হাজী মুহসিন কলেজ(প্রস্তাবিত কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় )প্রতিষ্ঠা করেন, পরে সেটি জাতীয়করণ করা হয়। আসামে ৩০ টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি কারিগরী শিক্ষা কলেজ, শিশু কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন সন্তোষে। এছাড়াও তিনি কাগমারিতে মওলানা মোহাম্মদ আলী কলেজ সন্তোষে (সন্তোষ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়)যা কিনা “মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়” ২০০২ সাথে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এটি প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে ৩য় স্থান এ আছে।
ভাষা আন্দোলনে বিশেষ অবদানের জন্য ২০০২ সালে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক তাকে মরণোত্তর একুশে পদকে ভূষিত করা হয়। ২০০৪ সালে বিবিসি জরিপে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি তালিকায় তিনি ৮ম হন।
আবদুল হামিদ খান ভাসানীর দৌহিত্র আজাদ খান ভাসানী তার দাদার সম্পর্কে বলেন, ‘মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর জীবনপঞ্জি লিখতে গিয়ে দেখছি- জীবনের শুরু থেকে শেষ অবধি তিনি দেশ, মাটি আর মানুষের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেছেন। একটি শোষণহীন, অসাম্প্রদায়িক, সমতা আর পালনবাদী সমাজ ব্যবস্থার জন্য নিজের জীবনের সর্বস্ব ত্যাগ করেছেন। মানব মুক্তির আদর্শ থেকে তিনি এক দিনের জন্যও বিচ্যুত হননি বা অবসর খোঁজেননি। জীবনের প্রায় প্রতিটি বছর, মাস, সপ্তাহ, দিন তিনি আন্দোলন, সংগ্রাম, কর্মসূচির মধ্যেই থেকেছেন। পৃথিবীর ইতিহাসে এত দীর্ঘকালব্যাপী ও ধারাবাহিকভাবে কেউ সক্রিয় আন্দোলন, সংগ্রাম, কর্মসূচির ভেতর থেকেছেন বলে আমার জানা নাই।’
১৯২৫ সালে মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী জয়পুরহাটের পাঁচবিবি উপজেলার জমিদার শামসুদ্দিন আহম্মদ চৌধুরীর মেয়ে আলেমা খাতুন ভাসানীকে বিবাহ করেন। যিনি (পীর মা হিসেবে খ্যাত) যিনি তার বাবা পাঁচবিবির জমিদার কর্তৃক পৈতৃক সুত্রে প্রাপ্ত সকল জমি মওলানা ভাসানীর জনকল্যাণমূলক কাজে (হক্কুল এবাদ মিশন) এ দান করেন।মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর ২য় সহধর্মিনী হামিদা খানম ভাসানী ১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দে বগুড়া জেলার আদমদিঘি থানার কাঞ্চনপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা কাসেম উদ্দিন সরকার জমিদারশ্রেণীভুক্ত একজন সমাজ হিতৈষি ধমপ্রাণ মুসলমান ছিলেন। অত্র এলাকায় কৃষক সংগঠনের রেশ ধরেই মওলানা ভাসানীর সাথে তাঁর পরিচয়। ১৯৬৪ খ্রিষ্টাব্দের ২৮ ডিসেম্বর (বাংলা ১৩ পৌষ), সোমবার সুবেহ সাদিকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দুরারোগ্য ক্যান্সার ব্যাধীতে মত্যুবরণ করেন হামিদা খানম।