গণবাণী ডট কম:
দেশে বিরোধীদল বিএনপির পাশাপাশি একজন নির্বাচন কমিশনারের বিরোধিতা করার পরও রাজনৈতিক দলের নিবন্ধনের ব্যাপারে একটি নতুন আইনের খসড়া অনুমোদন করেছে নির্বাচন কমিশন। ভিন্নমত পোষণকারি নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার বলেছেন, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে নিবন্ধনের বিধান থাকার পরও আলাদা আইন তৈরি করার প্রয়োজন নেই।
বিএনপি নেতারা বলেছেন, রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করার উদ্দেশ্য নিয়েই আইন তৈরি হচ্ছে বলে তারা মনে করেন।
তবে, প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে. এম. নুরুল হুদা বৃটিশ গণমাধ্যম বিবিসিকে বলেছেন, এখন স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার নির্বাচনগুলোও দলীয়ভাবে হওয়ার কারণে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ থেকে নিবন্ধনের প্রসঙ্গ আলাদা করে নতুন আইন করা হচ্ছে।
সেনা-সমর্থিত তত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে ২০০৮ সালে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ সংশোধন করে শর্ত সাপেক্ষে রাজনৈতিক দলের নিবন্ধনের বিধান আনা হয়েছিল।
এখন সেখান থেকে দলগুলোর নিবন্ধনের এই বিধান আলাদা করে স্বতন্ত্র আইন করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
‘রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন আইন ২০২০’ - এই নাম দিয়ে এর খসড়া বুধবার নির্বাচন কমিশনের বৈঠকে অনুমোদন দেয়া হয়েছে।
তবে প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ মোট পাঁচজন সদস্যের সেই বৈঠকে একজন নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার বিরোধিতা করে নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছেন। মি. তালুকদার বলেছেন, প্রয়োজন না থাকলেও স্বতন্ত্র আইন করা হলে তা গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের অঙ্গহানি করবে বলে তিনি মনে করেন।
“আমি এর বিরোধিতা করি। কারণ গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২ - এটা একটা ঐতিহাসিক আইনগত দলিল। এজন্য আমি মনে করি, নির্বাচন কমিশনের এই প্রস্তাব গৃহীত হলে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২-এর অঙ্গহানি ঘটবে। কোন্ যুক্তিতে এই পরিবর্তন প্রয়োজন হয়েছে, তা আমার কাছে বোধগম্য নয়।”
উনিশশো বাহাত্তর সালের গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ বিভিন্ন সময় সংশোধন করা হয়েছে।
দু’হাজার আট সালে রাজনৈতিক দলের নিবন্ধনের যে বিধান আনা হয়, সেই বিধানে থাকা তিনটি শর্তের একটি পূরণ করলেই কোন দল নিবন্ধনের জন্য যোগ্য বিবেচিত হচ্ছে।
এই শর্ত তিনটি হচ্ছে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর যে কোন একটি নির্বাচনে একটি দলের অন্তত একটি আসন অথবা পাঁচ শতাংশ ভোট পাওয়ার রেকর্ড থাকতে হবে। এছাড়া একটি দলের কমপক্ষে ২১টি জেলায় বা দু’শ উপজেলায় কমিটি থাকতে হবে। এখন স্বতন্ত্র আইনের খসড়ায় দু’টি শর্ত পূরণের বাধ্যবাধকতা রাখা হয়েছে। এছাড়া পরোক্ষ কিছু শর্ত রাখারও প্রস্তাব করা হয়েছে।
এর বিরোধিতা করে বিরোধী দল বিএনপি তাদের বক্তব্য লিখিতভাবে নির্বাচন কমিশনকে জানিয়েছিল।দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম বলছেন, এমন আইন গণতন্ত্রের পরিপন্থী এবং তা গ্রহণযোগ্য হবে না।
“এই নিবন্ধন আইন গণতন্ত্রকে আরও ক্ষতিগ্রস্ত করবে এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ন্যূনতম যতটুকু সুযোগ, সেটাও নষ্ট করবে। অত্যন্ত দূর্ভাগ্যের কথা যে এই নির্বাচন কমিশন তারা একটা লক্ষ্য নিয়ে নেমেছে যে কি করে বাংলাদেশে গণতন্ত্রকে ধ্বংস করবে, নির্বাচন প্রক্রিয়াকে ধ্বংস করবে। এটা করতে গিয়ে তারা আজ কফিনে শেষ পেরেকটুকু মারছে।”
বিএনপি নেতা মি. আলমগীর আরও বলেছেন, “এই নিবন্ধন আইনের মধ্যে তারা যে শর্তগুলো জুড়ে দিয়েছে এবং নতুন করে তারা যেগুলো করছে, এগুলো কোনভাবেই গণতন্ত্রের পক্ষে হতে পারে না। তারা এখানে কিছু শব্দ ইংরেজি থেকে বাংলা করছে এবং বাংলা শব্দকেও পরিবর্তন করছে, যেগুলো কমনভাবে ব্যবহার করা হয়, সেগুলোও তারা পরিবর্তন করছে।”
তবে নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা বলেছেন, এখনকার বিধানে নিবন্ধিত দলগুলোর সব পর্যায়ে কমিটিতে ৩৩% নারী সদস্য রাখার জন্য ২০২০ সাল পর্যন্ত অর্থ্যাৎ ১২ বছর পর্যন্ত সময় দেয়া হয়েছিল। কোন দলই এখনও তা করতে পারেনি। সেজন্য আবারও সময় বাড়াতে হবে এবং বিধান সংশোধন করতে হবে।
এছাড়া স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলো এখন দলীয়ভাবে করা হচ্ছে। এসব বিষয় বিবেচনা করে স্বতন্ত্র আইন করা হচ্ছে।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদা বলেন, “গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ হচ্ছে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বিধান। সেই বিধানের মধ্যে রাজনৈতিক দলের নিবন্ধনের বিষয় থাকাটা প্রাসঙ্গিক হয় না। এটা ২০০৮ সালে সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে তাড়াহুড়ো করে করা হয়েছিল।
“সেটা এখন আলাদা করা হচ্ছে। এছাড়া স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় মনোনয়নের ক্ষেত্রে দলের নিবন্ধনের প্রশ্ন আসতে পারে। সেজন্যও নিবন্ধনের স্বতন্ত্র আইন প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।”
তবে এমন যুক্তি বিশ্লেষকদেরও অনেকে মানতে রাজি নন।
নির্বাচন কমিশনের সাবেক একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা জেসমিন টুলী বলেছেন, “আমারতো মনে হয় না, এটা আলাদা করাটা খুবই প্রয়োজন। আমি তো এটা একদম আলাদা করার কোন প্রয়োজন অনুভব করছি না।”
নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা বলেছেন, তারা তাদের খসড়া প্রস্তাব নিয়ে আবারও রাজনৈতিক দলগুলো মতামত নিতে পারেন। খসড়াটি মন্ত্রীসভার অনুমোদন এবং সংসদে পাশের জন্য সরকারের কাছে পাঠানো হবে। সেই পর্যায়েও মতামত নেয়ার সুযোগ রয়েছে।