গণবাণী ডট কম:
গ্রামীণ টেলিকমের চেয়ারম্যান ও নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসসহ চারজনকে শ্রম আইন লঙ্ঘনের মামলায় ছয় মাস করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। ঢাকার তৃতীয় শ্রম আদালতের বিচারক বেগম শেখ মেরিনা সুলতানা জনাকীর্ণ আদালতে সোমবার এ রায় দেন।
শ্রম আইনে এ মামলায় পৃথক দুটি ধারায় আদালত সাজা প্রদান করেন। একটি ধারায় মামলায় ড. ইউনূসসহ চার আসামীকে ছয় মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড ও পাচঁ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে ১০ দিনের জেল দেয়া হয়েছে। অপর একটি ধারায় ২৫ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে ১৫ দিনের জেল দিয়ে রায় ঘোষণা করা হয়।
শ্রম আইন লঙ্ঘনের যেসব ধারায় ড. ইউনূসসহ চারজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়, সেসব ধারায় সর্বোচ্চ সাজা ৬ মাসের কারাদণ্ড ও ২৫ হাজার টাকা জরিমানা।
সোমবার বেলা তিনটার দিকে এই রায় ঘোষণা করা হয়। এর আগে, দুপুর ২টা ১৫ মিনিটের দিকে ঢাকার শ্রম আদালত-৩ এর বিচারক বেগম শেখ মেরিনা সুলতানার ৮৪ পৃষ্ঠার এ রায় ঘোষণা শুরু করেন। দুপুর ১টা ৪৫ মিনিটে তিনিসহ চার আসামিরা আদালতে হাজির হন।
দণ্ড পাওয়া অপর তিনজন হলেন গ্রামীণ টেলিকমের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আশরাফুল হাসান, পরিচালক নুর জাহান বেগম ও মো. শাহজাহান।
রায় ঘোষণার পর আসামী পক্ষের আইনজীবীরা ৩০ দিনের মধ্যে আপিল করার শর্তে জামিন চাইলে পাঁচ হাজার টাকার বন্ডে আদালত সেই আবেদন মঞ্জুর করেছেন। অর্থাৎ আগামী একমাসের মধ্যে তাদের শ্রম আপিলেট ট্রাইবুনালে আপিল করতে হবে। ফলে ড. ইউনূসকে এখনই জেলে যেতে হচ্ছে না।
ড. ইউনূসসহ চারজনের বিরুদ্ধে ২০২১ সালের ৯ সেপ্টেম্বর মামলাটি করে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর। মামলায় গত ৬ জুন ড. ইউনূসসহ চারজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন আদালত। অভিযোগ গঠনের আদেশ বাতিল চেয়ে উচ্চ আদালতে আবেদন করেছিলেন ড. ইউনূস ও অন্যরা। আপিল বিভাগ গত ২০ আগস্ট সেই আবেদন চূড়ান্তভাবে খারিজ করে দেন।
এরপর গত ২২ আগস্ট শ্রম আদালতে এই মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়, যা শেষ হয় গত ৯ নভেম্বর। এতে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের চার কর্মকর্তা সাক্ষ্য দেন। গত ২৪ ডিসেম্বর এ মামলায় উভয়পক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে রাত সোয়া ৮টার দিকে রায়ের জন্য আজকের দিন (১ জানুয়ারি) ধার্য করেছিলেন আদালত।
ড. ইউনূসের রায় ঘোষণাকে কেন্দ্র করে শ্রম আদালত ও আশেপাশে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। বিপুল সংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। খবর সংগ্রহের জন্য রায় ঘোষণার এক ঘণ্টা আগে দেশের ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের প্রতিনিধিরা ভিড় জমায়।
রায় ঘোষণার সময় আদালত বলেন, মুহাম্মদ ইউনূসসহ অন্যদের বিরুদ্ধে শ্রম আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে।
রায়ের পরে আদালতের বাইরে এক প্রতিক্রিয়া ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ”যে দোষ আমরা করি নাই, সেই দোষের ওপরে শাস্তি পেলাম। এটা আমাদের কপালে ছিল, জাতির কপালে ছিল, আমরা সেটা বহন করলাম।”
ড. ইউনূসের আইনজীবী আব্দুল্লাহ আল মামুন আদালতের বাইরে সাংবাদিকদের বলেছেন, ”আমরা এই ব্যাপারে ক্ষুব্ধ। লেবার কোর্টের ইতিহাসে এতো তাড়াতাড়ি ড. ইউনূসের মামলার শুনানির জন্য ১০টি ডেট দেয়া হয়েছে। নিজেরা তড়িঘড়ি, ইতিহাস ব্রেক করে, সাড়ে আটটা পর্যন্ত ইতিহাস ব্রেক করে, শুনানি করে আজকের এই রায় ঘোষণা করা হয়েছে।”
”আমরা বিক্ষুব্ধ, এই রায় অন্যায় এবং আইন বিরোধী। আমরা ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হয়েছি। আমরা এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করবো। রাষ্ট্রপক্ষ কোন কিছু প্রমাণ করতে পারেনি। আপিল কোর্টে আমরা এর বিরুদ্ধে প্রতিকার চাইবো।” বলেন মি. মামুন।
এই রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে কলকারখানা অধিদপ্তরের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বলেন, ”আমরা অভিযোগ প্রমাণ করতে পেরেছি। প্রত্যাশিত রায় পেয়েছি। আমরা মনে করি, প্রতিষ্ঠান মালিকরা এখন সতর্ক হবে। কেউ আইনের উর্ধ্বে নয়। আইন লঙ্ঘন হলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।”
এ মামলার অভিযোগের মধ্যে রয়েছে, অনিয়মের মাধ্যমে শ্রমিক কর্মচারীদের মধ্যে বণ্টনের জন্য সংরক্ষিত লভ্যাংশের পাঁচ শতাংশ না দেয়া এবং ১০১ জন শ্রমিকের চাকরি স্থায়ী না করা। এছাড়া গণছুটি না দেয়া, শ্রমিকদের কল্যাণ তহবিল এবং অংশগ্রহণ তহবিল গঠন না করাও অন্যতম অভিযোগ এই মামলার।
এ মামলায় চারজন আসামির পক্ষে আদালতে লিখিত বক্তব্য দেয়া হয়। এতে বলা হয়, গ্রামীণ টেলিকম যেসব ব্যবসা পরিচালনা করে, সেসব চুক্তিভিত্তিক। নির্দিষ্ট মেয়াদ শেষে তা নবায়নের মাধ্যমে পরিচালনা করা হয়।
যেহেতু এ প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম চুক্তির ভিত্তিতে পরিচালিত হয় তাই সব কর্মকর্তা-কর্মচারীকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়া হয়েছে বলেও জানানো হয়। বক্তব্যে আরো বলা হয়, মিথ্যা অভিযোগে অধিদপ্তরের শ্রম পরিদর্শক আরিফুজ্জামান মামলাটি করেছেন।
অধ্যাপক ইউনূস এ মামলায় সাফাই সাক্ষ্য দেন নি। তার আইনজীবী আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেছেন, “মামলা প্রমাণ করার দায়িত্ব কলকারখানা অধিদপ্তরের। তাই (অধ্যাপক ইউনূসের) সাফাই সাক্ষ্য দেয়ার প্রয়োজন নেই।”
মামলাটি হওয়ার পর আত্মসমর্পণ করে জামিন চান অধ্যাপক ইউনূস। মোট ৩৬ দিন জামিনে ছিলেন তিনি। পরে মামলার অভিযোগ আমলে নেয়ার পর তাকে ব্যক্তিগত হাজিরা থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। সব মিলে নয় দিন শুনানিতে উপস্থিত ছিলেন তিনি।
খবর : বিবিসি, বাসস ও অন্যান্য সূত্র।