গণবাণী ডট কম:
গাজীপুর মহানগরীর টঙ্গীর তুরাগ নদের তীরে তাবলিগ জামাতের ৫৫তম ইজতেমার দ্বিতীয় পর্ব শুরু হবে শুক্রবার। ইতিমধ্যে জেলা প্রশাসন, সিটি কর্পোরেশন, তাবলীগের সাথীসহ সংশ্লিষ্ট সকলের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ইজতেমা ময়দান প্রস্তুত করা হয়েছে। সম্পন্ন হয়েছে সকল আয়োজন। নিরাপত্তার জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রায় ৮ হাজার সদস্যদের সমন্বয়ে গঠিত ৫ স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা।
আলমী শুরার তত্বাবধানে মাওলানা যোবায়ের অনুসারীদের অংশ গ্রহণে প্রথম পর্বের ইজতেমা গত ১২ জানুয়ারি শান্তিপূর্ণভাবে সমাপ্ত করে অংশ গ্রহণকারীরা ময়দান ছেড়ে চলে যাবার পর ১৪ জানুয়ারি রাতে ইজতেমা ময়দান দিল্লীর নিজামউদ্দিন মারকাজের মাওলানা সাদ আহমদ কান্ধলভীর অনুসারীদের বুঝিয়ে দেয়া হয়। সোমবার রাতে গাজীপুর জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে ইজতেমা আয়োজকদের কাছে ময়দানের মাইক, লাইট, সামিয়ানার চটসহ যাবতীয় মালামাল বুঝিয়ে দেওয়া হয়।
১৬০ একর জমির ওপর নির্মিত সুবিশাল প্যান্ডেলের ভিতর প্রায় ৯ হাজার খুঁটিতে নম্বর প্লেট, খিত্তা নম্বর, জুড়নেওয়ালি জামাতের কামরা, মুকাব্বির মঞ্চ, বয়ান মঞ্চ, তাশকিল কামরা, পাহারা ও এস্তেকবালের জামাত তৈরি, হালকা নম্বর বসানোর কাজ শেষ হয়েছে।
প্রথম পর্বের মুসুল্লীদের ব্যবহারের পর ময়দানের ময়লা আবর্জনা পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার কাজ শেষ হয়েছে। প্রথম পর্বের মুসল্লিদের ফেলে যাওয়া উচ্ছিষ্ট, কাগজ, পলিথিন, বিছানার হোগলা ইত্যাদি সরিয়ে ফেলা হয়েছে। সামিয়ানার নীচে ঝাড়-মুছ করা হয়েছে। ইজতেমা ময়দানের চারপাশে তৈরি করা হাজার হাজার কাঁচা-পাকা বাথ রুম, ওজু-গোসল ও রান্না-বান্নার স্থান ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করা হয়েছে। এছাড়া ছিড়ে যাওয়া, খসে পড়া চট ঠিক করে বাধাসহ নতুন করে সাজানো হচ্ছে। পুরো ময়দানকে ৩টি সংরক্ষিত খিত্তাসহ ৮৭ খিত্তায় সাজানো হচ্ছে। এসব কাজগুলো জামাতবন্দী মুসল্লিরা স্বেচ্ছাশ্রমে করেছেন।
তাবলিগ জামাতের নেতৃত্বকে কেন্দ্র করে এবারও দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে দ্বিতীয়বারের মত অনুষ্ঠিত হচ্ছে দুই পর্বের ইজতেমা। ইজতেমার প্রথম পর্বের তিন দিন বরাদ্দ ছিল ভারতের দেওবন্দ মাদরাসার মাওলানা যোবায়ের ও ছেলে জুহাইরুল হাসানের অনুসারীদের জন্য। শুক্রবার তাবলিগ জামাতের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা ইলিয়াছ আহমদের নাতি দিল্লির মারকাজের শীর্ষ মুরব্বী মাওলানা সা’দ আহমাদ কান্ধলভির অনুসারীদের ৩দিন ব্যাপী ইজতেমা শুরু হবে।
দ্বিতীয় পর্বেও দেশের সকল জেলার মুসল্লিসহ বিশ্বের প্রায় শতাধিক বিদেশি রাষ্ট্রের ১০ হাজার মেহমান ইজতেমায় অংশ নিবেন বলে জানিয়েছেন ইজতেমা আয়োজক কমিটি। রোববারের মোনাজাতে ২০-২৫ লাখ মুসল্লি অংশ নেবেন বলেও তারা ধারণা করছেন। এ পর্বের ইজতেমায়ও মোনাজাত পূর্ব পর্যন্ত আগত মুসল্লিদের উদ্দেশ্যে ইমান আমলের ওপর তাবলিগ জামাতের শীর্ষস্থানীয় দেশি-বিদেশি বুজুর্গ মুরুব্বিরা বিভিন্ন ভাষায় পর্যায়ক্রমে মূল্যবান বয়ান করবেন।
ইতিমধ্যে কনকনে শীত, ঘন কুয়াশা উপেক্ষা করে বুধবার থেকেই মুসল্লিরা দলে দলে জামাতবন্দি হয়ে তুরাগ তীরে আসতে শুরু করেছেন মুসুল্লীরা। অসীম অনন্ত প্রেমময় আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে ইবাদত বন্দেগি আর কোরআন হাদিসের আলোচনায় এখন ইজতেমার সামিয়ানার নিচে বিরাজ করছে ধর্মীয় আবহ। বিভিন্ন যানবাহনে, যানজট এড়াতে আশপাশের এলাকা থেকে পায়ে হেঁটে হেঁটে এবং আকাশ পথে বিদেশি মুসল্লিরা ইজতেমা ময়দানে আসছেন। ইতোমধ্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে কয়েকশ বিদেশি মুসল্লি ইজতেমা ময়দানের বিদেশি খিত্তায় এসে অবস্থান নিয়েছেন।
প্রথম পর্বের ন্যায় এবারও ইজতেমা ময়দানে লাখো মুসল্লির সমাগমকে কেন্দ্র করে টঙ্গী, উত্তরা, তুরাগ, কামারপাড়া, আব্দুল্লাহপুরসহ বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠেছে অসংখ্য ভাসমান দোকানপাট ও হোটেল-রেস্তোরাঁ।
এদিকে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের উভয় পাশের ইজতেমা ময়দানের আশপাশের প্রথম পর্বের ইজতেমার পর ময়দানের চারপাশে জমে থাকা ময়লা আর্বজনা ও পয়ঃনিষ্কাশন যথাযথভাবে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন না করায় ময়দানের চারপাশে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। ময়দানের চারপাশে ময়লা আবর্জনার দুর্গন্ধ আর ধুলোবালি উড়ছে। এমন অগোছালো অপরিচ্ছন্ন দুর্গন্ধময় পরিবেশেই শুরু হচ্ছে দ্বিতীয় পর্বের ইজতেমা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক মুসল্লি ময়লা-আবর্জনা না সরানোয় ও ধুলাবালির বিষয়ে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের দায়িত্ব প্রাপ্ত কর্মকর্তাদের গাফলতি মনে করছেন।
গাজীপুর সিটি করপোরেশন (টঙ্গী অঞ্চল) উপ-সহকারি প্রকৌশলী (যান্ত্রিক) মো. আমজাদ হোসেন বলেন, ময়দানে প্রথম পর্বের গৃহীত পদক্ষেপ ছাড়াও নতুন করে ৫০০ ট্রাক বালি ফেলে উচুঁ করা হচ্ছে। এছাড়াও সিটি করপোরেশনের কনজারভেন্সী ৩০০ ও বাইরের ২০০ মোট ৫০০ শ্রমিক একনাগাড়ে ময়দান প্রস্তুতের কাজ করে যাচ্ছে। দ্বিতীয় পর্বের মুসল্লিদের সুবিধার্থে ইজতেমার পুরো ময়দানে ৮০০ ড্রাম ব্লিচিং পাউডার ছিটানো হচ্ছে।
গাজীপুর জেলার প্রশাসক এসএম তরিকুল ইসলাম জানান, ইজতেমা শুরুর আগের দিন থেকে টঙ্গী ও আশপাশের এলাকায় আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এছাড়াও পঁচাবাসী খাবার সরবরাহসহ বিভিন্ন অপরাধীদের নিয়ন্ত্রনসহ তাদের তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিতে বেশ কয়েকটি মোবাইল কোর্ট টিম কাজ করবে।
গাজীপুর মেট্রোপলিটনের পুলিশ কমিশনার মো. আনোয়ার হোসেন জানান, দিতীয় পর্বেও নিরাপদ পরিবেশে ইজতেমা আয়োজনে পুলিশের পক্ষ থেকে সার্বিক প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে। নিরাপত্তার জন্য গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের পাশাপাশি জেলা পুলিশ, র্যা ব ও আনছার বাহিনী থাকবে। এ বারের ইজতেমায় সাদা পোশাকের পুলিশ সদস্য থাকবে তার সাথে ৫ স্তরের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হবে। কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ছাড়া দিতীয় পর্বের ইজতেমাও সফলভাবে সম্পন্ন হবে।
মুসুল্লীদের প্রতি পরামর্শ :
ইজতেমায় শরিক হওয়া মুসল্লিদের নানা রকমের মতর্ক বার্তা দেওয়া হয়েছে। সন্দেহজনক কোন বস্তু চোখে পড়লে তাৎক্ষণিক আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে অবহিত করা, প্রধান সড়ক ও আশপাশে তাবু না টানানো, অপরিচিত লোকের দেওয়া কোন কিছু না খাওয়া, অসুস্থ হয়ে পড়লে নির্দিষ্ট হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়া, টাকা ও মাল নিজ হেফাজতে রাখা, যে কোন বিপদে প্রশাসনের সাহায্য নেওয়া ইত্যাদি লেখা সম্বলিত সতর্কতামূলক লিফলেট বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিলি করা হয়েছে।
বিদেশি মুসল্লিদের প্রতি সতর্কতা :
প্রথম পর্বের চেয়ে এ পর্বের ইজতেমায় আরও অধিকসংখ্যক বিদেশি মুসল্লি অংশ নিবেন বলে আশা করা হচ্ছে। তাদের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা দেওয়া হবে। এছাড়াও আর্ন্তজাতিক নিবাসে মেহমানদের রান্না-বান্নায় বিশেষ নজর রাখার জন্য বলা হয়েছে। যাতে তাদের ফুড পয়জনিং (খাদ্যে বিষক্রিয়া) না হয়।
মহিলারাও ইজতেমায় : ইজতেমার ময়দানের আশপাশের বাসা-বাড়ি ও বস্তিগুলোতে সারাদেশ থেকে মা বোনেরা মোনাজাতে অংশ নিতে ইতিমধ্যে এসে পৌঁছেছেন। জানা গেছে, কেউ আত্মীয় স্বজনের বাসায় উঠেছে। কেউ কেউ পুরো মাসের ভাড়া দিয়ে মোনাজাতের জন্য রুম ভাড়া নিয়েছেন।
খিত্তাওয়ারী জেলা :
আগামী শুক্রবার (১৭ জানুয়ারি) শুরু হওয়া দ্বিতীয় পর্বের ইজতেমায় আগত মুসল্লিরা অঞ্চল ভিত্তিক যে সমস্ত খিত্তায় অবস্থান করবেন তা হলো: মিরপুর (খিত্তা-১, ২), সাভার (খিত্তা-৩ ও ৪), টঙ্গী (খিত্তা-৫), উত্তরা (খিত্তা-৬ ও ৭), কাকরাইল (খিত্তা-৮, ৯, ১০, ১১, ১২, ১৩ ও ১৪), মোহাম্মদপুর (খিত্তা-১৫), যাত্রাবাড়ি (খিত্তা-১৬), ডেমড়া (খিত্তা-১৭), কেরানীগঞ্জ (খিত্তা-১৮ ও ১৯), ধামরাই (খিত্তা-২০), নবাবগঞ্জ/দোহার (খিত্তা-২১), মানিকগঞ্জ (খিত্তা-২২), টাঙ্গাইল (খিত্তা-২৩), নারায়নগঞ্জ (খিত্তা-২৪), নেত্রকোনা (খিত্তা-২৫), জামালপুর (খিত্তা-২৬), ময়মনসিংহ (খিত্তা-২৭), কিশোরগঞ্জ (খিত্তা-২৮), শেরপুর (খিত্তা-২৯), গাজীপুর (খিত্তা-৩০), বগুড়া (খিত্তা-৩১), নরসিংদী (খিত্তা-৩২), নওগাঁ (খিত্তা-৩৩), রাজশাহী (খিত্তা-৩৪), নাটোর (খিত্তা-৩৫), সিলেট (খিত্তা-৩৮), সুনামগঞ্জ (খিত্তা-৩৯), হবিগঞ্জ (খিত্তা-৪০), মৌলভীবাজার (খিত্তা-৪১), চাপাইনবাবঞ্জ (খিত্তা-৪২), জয়পুরহাট (খিত্তা-৪৩), মুন্সিগঞ্জ (খিত্তা-৪৪), মাদারীপুর (খিত্তা-৪৫), শরীয়তপুর (খিত্তা-৪৬), রাজবাড়ি (খিত্তা-৪৭), ফরিদপুর (খিত্তা-৪৮), গোপালগঞ্জ (খিত্তা-৪৯), পঞ্চগড় (খিত্তা-৫০), নীলফামারী (খিত্তা-৫১), লালমনিরহাট (খিত্তা-৫২), গাইবান্ধা (খিত্তা-৫৩), কুড়িগ্রাম (খিত্তা-৫৪), ঠাকুরগাঁও (খিত্তা-৫৫), রংপুর (খিত্তা-৫৬), দিনাজপুর (খিত্তা-৫৭), বি.বাড়ীয়া (খিত্তা-৫৮), চাঁদপুর (খিত্তা-৫৯), খাগড়াছড়ি (খিত্তা-৬০), ফেণী (খিত্তা-৬১), রাঙ্গামাটি (খিত্তা-৬২), বান্দরবন (খিত্তা-৬৩), লক্ষীপুর (খিত্তা-৬৪), নোয়াখালী (খিত্তা-৬৫), কুমিল্লা (খিত্তা-৬৬), কক্সবাজার (খিত্তা-৬৭), চট্টগ্রাম (খিত্তা-৬৮), চুয়াডাঙ্গা (খিত্তা-৬৯), কুষ্টিয়া (খিত্তা-৭০), খুলনা (খিত্তা-৭১), যশোহর (খিত্তা-৭২), ঝালকাঠি (খিত্তা-৭৩), পটুয়াখালী (খিত্তা-৭৪), বরিশাল (খিত্তা-৭৫), ভোলা (খিত্তা-৭৬), বরগুনা (খিত্তা-৭৭) ও পিরোজপুর (খিত্তা-৭৮)।
তুরাগ নদের পশ্চিমপাড়ে অবস্থিত খিত্তাগুলো হলো- পাবনা (খিত্তা-৩৬), সিরাজগঞ্জ (খিত্তা-৩৭), মাগুড়া (খিত্তা-৭৯), সাতক্ষীড়া (খিত্তা-৮০), নড়াইল (খিত্তা-৮১), ঝিনাইদহ (খিত্তা-৮২), বাগেরহাট (খিত্তা-৮৩) ও মেহেরপুর (খিত্তা-৮৪)। এছাড়াও ৮৫, ৮৬ নং খিত্তা ও তুরাগ নদের পশ্চিম পাড়ে অবস্থিত ৮৭ নম্বর খিত্তাগুলো সংরক্ষিত খিত্তা হিসেবে রাখা হয়েছে।
মুসল্লিরা তাদের নিজ নিজ খিত্তায় অবস্থান নিয়ে ইবাদত বন্দেগি, জিকিরে মশগুল থাকবেন। নির্ধারিত খিত্তার বাইরে কাউকে অবস্থান না নিতে অনুরোধ জানানো হয়েছে।
আগামী শুক্রবার বাদ ফজর আম বয়ানের মধ্য দিয়ে শুরু হয়ে ১৯ জানুয়ারি দুপুরে অর্থাত্ জোহরের নামাজের আগে যে কোনো সময় আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে এবার বিশ্ব ইজতেমার দ্বিতীয় পর্ব তথা ৫৫তম বিশ্ব ইজতেমার সমাপ্তি ঘটবে।