কাপাসিয়া (গাজীপুর) প্রতিনিধি :
সারাদেশেই চলছে ‘অঘোষিত লকডাউন’। মানুষকে ঘরে থাকার নির্দেশনা দিয়ে সাধারণ ছুটি দুই দফা বাড়ানো হয়েছে। করোনাভাইরাস প্রতিরোধে সব ধরণের সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় জনসমাগমে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে সরকার। বন্ধের আওতায় রয়েছে সব ধরনের শিল্প প্রতিষ্ঠানও। তবে সব ধরনের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে উৎপাদন চলছিল গাজীপুরের কাপাসিয়ার ‘আনান ফুটওয়্যার অ্যান্ড লেদার গুডস লিমিটেড’ নামক কারখানায়।
সোমবার বেলা পৌনে ১২টার দিকে উপজেলার কাপাসিয়া ইউনিয়নের পাবুর গ্রামের ওই কারখানায় ঢুকে দেখা যায়, প্রায় সাড়ে তিনশ শ্রমিক উৎপাদন কাজে ব্যস্ত। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে তাদের নিরাপত্তায় কোনও ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি কর্তৃপক্ষ। করোনাভাইরাস সংক্রমণ প্রতিহতকরণে দেশের সব কারখানায় থার্মাল স্ক্যানার ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হলেও এখানে সেটি নেই। নেই কোনও জীবানুনাশক স্প্রে’র ব্যবস্থা। নিরাপত্তা বলতে মূল ফটকের সামনে রাখা নিল ড্রামের পানি ও সাবান।
সাংবাদিক পরিচয়ে ভেতরে ঢোকার পর হাতে দু’ফুটো হ্যান্ড স্যানিটাইজার লাগিয়ে দেন একজন বয়োজ্যেষ্ঠ নিরাপত্তা কর্মী। এরপর কথা হয় কারখানার এডমিন অফিসার মেজবাহ উদ্দিনের সঙ্গে। তিনি জানালেন, কারখানায় তাদের ৩৭২ জন শ্রমিক রয়েছে। এর মধ্যে ৬০ ভাগ নারী। স্পোর্টস সুজ, চামড়ার ভ্যানিটি ব্যাগ ও পার্স তৈরি করা হয় কারখানাটিতে।
কারখানাটি ঘুরে দেখা যায়, ইউরোপিয়ান ক্যানবো কোম্পানীর অর্ডার সরবরাহ করতে আজ উপস্থিত থাকা ৩৩৩ জন্য শ্রমিকের দম ফেলার সময় নেই। মুখে সাধারণ মাস্ক লাগিয়ে সারিবদ্ধ ভাবে গাঁ ঘেষে বসে কাজ করছেন তারা। কর্মকর্তাদের হাতে হ্যান্ড গ্লাভস থাকলেও শ্রমিকদের হাতে নেই।
চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মুখোমুখি দাঁড়ালে একজন থেকে অপরজনের দূরত্ব হতে হবে ছয় ফুট আর সারি বেঁধে দাঁড়ালে বা বসলে তিন ফুট দূরত্ব থাকতে হবে। কিন্তু শ্রমিকদের কর্মক্ষেত্রে নির্দিষ্ট সামাজিক দূরত্বও নিশ্চিত করেনি কর্তৃপক্ষ।
জানতে চাইলে জেনারেল ম্যানেজার (জিএম) মো. সালাউদ্দিন তারেক বলেন, সব ধরণের নির্দেশ ও নিয়ম মেনেই কারখানা চলছে।
এরপর কারখানা চালুর বিষয়টি গাজীপুরের জেলা প্রশাসক এস এম তরিকুল ইসলাম ও কাপাসিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ইসমত আরাকে অবগত করা হয়। ইউএনও তাক্ষণিক কাপাসিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সাখাওয়াত হোসেন প্রধানকে কারখানায় পাঠান। তিনি এসে দ্রুত কারখানা বন্ধ করতে নির্দেশ দিয়ে চলে যান। কিন্তু এরপরও উৎপাদন চালু থাকায় ইউনএনও এসে কারখানাটি বন্ধ করে দেন। এরপর দাঁড়িয়ে থেকে একে একে শ্রমিকদের বের করে কারখানার জিএমকে সাবধান করে দেন ইউএনও। এসময় ইউএনওর সামনেই শ্রমিকদের সঙ্গে চড়াও হতে দেখা যায় জিএমকে।
জানতে চাইলে ইসমত আরা বলেন, সরকারি বিধি অনুযায়ী ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত কারখানাটি বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে। শ্রমিকদের পাওনা কারখানা চালুর পর পরিশোধের কথা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে।
ছুটির সময়েও কাজের বিষয়ে শ্রমিকরা বলছেন, কয়েকদিন কারখানা বন্ধ থাকলেও গত ৪ এপ্রিল থেকে উৎপাদন শুরু হয়। হাজিরা কেটে দেয়ার ভয় দেখিয়ে তাদের কাজে আনা হয়। ওভারটাইমের নামে কর্মঘণ্টার অতিরিক্ত খাটিয়েও তাদের সময়মতো দেয়া হচ্ছে না পারিশ্রমিক। শ্রমিকদের ২-৩ মাসের অতিরিক্ত কর্মঘণ্টার পাওনা পরিশোধ করা হয়নি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন শ্রমিক বলেন, সব ধরনের অনিয়ম থাকলেও শ্রমিকরা চাকরি হারানোর ভয়ে মুখ খুলতে সাহস পাচ্ছে না। ওভারটাইমের টাকা দিচ্ছে না। মাসের ১৫-২০ তারিখে বেতন দেয়া হয়। সারাদেশে সব কারখানা বন্ধ থাকলেও এখানে বেতন কাটার হুমকি ও চাপ দিয়ে শ্রমিকদের কাজ করাচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, যখন শিপম্যান্ট চলে তখন টানা ৩২ ঘণ্টাও কাজ করতে হয়। শ্রমিক আইন না মেনে নাম মাত্র বেতনে কাজ করানো হয়। অনেক সময় শ্রমিক-কর্মকর্তাদের গায়ে পর্যন্ত হাত তুলেন জেনারেল ম্যানেজার (জিএম) মো. সালাউদ্দিন তারেক।
তিনিসহ একাধিক শ্রমিক বলেন, সাংবাদিক ও ইউএনও না আসলে কর্তৃপক্ষের নির্দেশ মতো কারখানাটি আরও কয়েকদিন চালু থাকত।
এমন পরিস্থিতিতেও কারখানাটি খোলা রাখায় শ্রমিকদের ও স্থানীয়দের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন এলাকাবাসী।
কারখানা ছুটির পরও শ্রমিকরা ফটকের সামনে ভিড় করছিল। শ্রমিকদের সরাতে ব্যর্থ হয়ে হ্যান্ড মাইকে এডমিন অফিসার মেজবাহ উদ্দিন বলেন, সারা বাংলাদেশেই ফ্যাক্টরী বন্ধ হয়ে গেছে। এ কারণে আমাদেরও বন্ধ করা লাগল। আগামি ১৪ তারিখ পর্যন্ত কারখানা বন্ধ থাকবে। আপনারা গত মাসের বেতন পাবেন না। চলতি মাসের বেতন পাবেন। এ কথা বলতেই উত্তেজিত হয়ে পড়ে শ্রমিকরা। পরে শ্রমিকদের তোপের মুখে এডমিন অফিসার বলেন, আপনারা যার যার বাড়ি যান। ১৫ তারিখ ফ্যাক্টরীতে আসলে সিদ্ধান্ত জানানো হবে।
সার্বিক বিষয়ে বক্তব্য জানতে কারখানাটির মালিক নাজমুল আহসান সরকারের সঙ্গে ফোনে একাধিকবার চেষ্টা করেও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।