গণবাণী ডট কম:
গাজীপুর সদর সাব-রেজিস্ট্রার মো. মনিরুল ইসলামের বিরুদ্ধে জমির মূল্য কম দেখিয়ে রেজিস্ট্রি করার মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ ১৫ দিনের মধ্যে তদন্ত করার জন্য দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) চেয়ারম্যানকে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে ওই সাব-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া গেলে তিনি যাতে দেশত্যাগ করতে না পারেন সেজন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতেও বলা হয়েছে।
গাজীপুর সদর সাব-রেজিস্ট্রার কার্যালয়ের দলিল লেখক হাজি মো. আফসার উদ্দিন উক্ত সাব রেজিস্ট্রারে দুণীতির বিষয়ে হাইকোর্টে একটি রিট করেন। পরে রিট আবেদনের শুনানি নিয়ে হাইকোর্টের বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি এস এম মনিরুজ্জামানের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ গত ১০ অক্টোবর উল্লেখিত আদেশ দেন।
রিট আবেদনকারীর পক্ষে শুনানিতে আইনজীবী ছিলেন কাজী ওবায়দুর রহমান। অন্যদিকে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল প্রতীকার চাকমা।
উল্লেখ্য, আগামী ২০ থেকে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়ায় ভূমি রেজিস্ট্রেশন পদ্ধতি ও ব্যবস্থাপনা বিষয়ে এক প্রশিক্ষণ কর্মশালায় বাংলাদেশের ২০ জন সাব-রেজিস্ট্রারের অংশ নেয়ার কথা রয়েছে। ওই তালিকায় গাজীপুর সদরের সাব-রেজিস্ট্রার মো. মনিরুল ইসলামের নামও রয়েছে।
রিট আবেদনকারী ও তার আইনজীবী গণমাধ্যমকে জানান, আমরা সন্দিহান যে, ওই সাব-রেজিস্ট্রার দেশের বাইরে যেতে পারলে আর ফিরে আসবে কি-না? তারা বলেন, এর আগেও গত আগস্টে আইন পড়ার কথা বলে একবার লন্ডনে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন তিনি। আইন মন্ত্রণালয় দুই বছরের (২০১৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর থেকে ২০২১ সালের ১ সেপ্টেম্বর) ছুটিও মঞ্জুর করেছিল। কিন্তু সে চেষ্টায় ব্যর্থ হন তিনি।
হাইকোর্টের এই আদেশের কপি মঙ্গলবার দুদক কার্যালয়ে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে বলে গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন রিট আবেদনকারীর আইনজীবী।
রিট আবেদনে বলা হয়, জয়দেবপুর থানার সুরাবাড়ীর মো. হারুন সরকার ও তাঁ স্ত্রী সখিনা বেগম ওরফে সখিনা আক্তারের কাছ থেকে একই উপজেলার গোবিন্দবাড়ী মৌজায় ৪১ শতাংশ জমি কেনেন ঝিনাইদহ জেলার সদর উপজেলার বাজার গোপালপুর গ্রামের মৃত কফিলউদ্দিনের ছেলে মো. আবু জাফর। চালা প্রকৃতির জমি হিসেবে ২০১৭ সালের ১১ এপ্রিল জমিটি রেজিস্ট্রি (দলিল নম্বর-৩৪৬৪) করা হয়। জমির মূল্য দেখানো হয় ২০ লাখ টাক। কিন্তু সরকার ঘোষিত জমির মূল্য তালিকা অনুযায়ী গোবিন্দবাড়ী মৌজায় প্রতি শতাংশ চালা জমির মূল্য তিন লাখ সাত হাজার ৫৬৩ টাকা। এ হিসাবে ৪১ শতাংশ জমির মূল্য হওয়ার কথা এক কোটি ২৬ লাখ ১০ হাজার ৮৩ টাকা। এই জমিতে এক কোটি ছয় লাখ ১০ হাজার ৮৩ টাকার ওপর রাজস্ব ফাঁকি দেওয়া হয়েছে।
একইভাবে একই দাতা-গ্রহীতা সুরাবাড়ী মৌজায় ২২ শতাংশ জমি কেনাবেচা করেন, যার দলিল নম্বর ৩৪৬৩। এই দলিলে জমির প্রকৃতি দেখানো হয়েছে চালা। সরকার ঘোষিত জমির মূল্য তালিকা অনুযায়ী সুরাবাড়ী মৌজায় প্রতি শতাংশ চালা জমির মূল্য দুই লাখ ৯১ হাজার ৫৪৯ টাকা। এ হিসাবে ২২ শতাংশ জমির মূল্য হওয়ার কথা ৬৪ লাখ ১৪ হাজার ৭৮ টাকা। এই জমিতেও ৪৪ লাখ ১৪ হাজার ৭৮ টাকার ওপর রাজস্ব ফাঁকি দেওয়া হয়েছে।
এ ছাড়া কাশিমপুর মৌজায় ২০১৬ সালের ১৬ নভেম্বর ৮৭২০ নম্বর দলিলের মাধ্যমে ৭ শতাংশ জমি রেজিস্ট্রি করা হয়। জমির প্রকৃতি দেখানো হয় স্থাপনাবিহীন বাড়ি। মূল্য দেখানো হয়েছে ১৭ লাখ ৮৫ হাজার টাকা। কিন্তু সরকারের মূল্যতালিকা অনুযায়ী কাশিমপুর মৌজায় প্রতি শতাংশ ভিটি/বাড়ি প্রকৃতির জমির মূল্য দুই লাখ ৭৬ হাজার ৩৮৪ টাকা। এই হিসাবে রেজিস্ট্রি করা জমির মূল্য হওয়ার কথা ১৯ লাখ ৩৪ হাজার ৬৮৮ টাকা।
শুধু এই তিনটি দলিল নয়, এ রকম অসংখ্য দলিলের ফটোকপি রিট আবেদনের সঙ্গে সংযুক্ত করে বলা হয়েছে, এভাবে জমির মূল্য কম দেখিয়ে একদিকে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি দেওয়া হয়েছে, অন্যদিকে দুর্নীতির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন সাব রেজিস্ট্রার মনিরুল।
রিট আবেদনে বলা হয়, ওই সাব-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে গত ২৭ জুলাই দুদক, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, আইন মন্ত্রণালয়, নিবন্ধন অধিদপ্তর, বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা ও গাজীপুরের ডিসি-এসপির কাছে লিখিতভাবে দুর্নীতির অভিযোগ দাখিল করা হয়। আবেদনে মোট ৩৯টি দলিলের নম্বর উল্লেখ করে বলা হয়, এসব দলিলসহ আরও অসংখ্য দলিলের মাধ্যমে জমির মূল্য কম দেখিয়ে রাজস্ব ফাঁকি দেয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে কোটি কোটি টাকার দুর্নীতি হয়েছে। দুদকসহ সংশ্লিষ্টদের কাছে আবেদন দেয়া হলেও এখন পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
গাজীপুরে সদর সাব রেজিস্ট্রার অনেক প্রভাবশালী সরকারী কর্মকর্তা হিসাবে সুনাম রয়েছে। তার বিরুদ্ধে যারা কথা বলতে চেয়েছে বা বলেছে, তাদের অনেক করুন পরিণতি ভোগ করতে হয়েছে। জেলার স্থানীয় পত্রিকা দৈনিক মুক্তসংবাদ এই সাব রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলে পত্রিকাটির সম্পাদক কারাবরণ করেন। জেলার শ্রীপুর সাব রেজিস্ট্রি অফিসে এ কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দেয়া হলে স্থানীয় দলিল লেখকগণ তাকে প্রতিহত করতে আন্দোলন করেন। প্রায় মাসব্যাপী আন্দোলনে অনেক দলিল লেখককে মামলার আসামী হতে হয়।